শিউলি আপু এবং রবীন্দ্রনাথের গল্প ‘সমাপ্তি’
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৪, ২০২০
আজ শিউলি আপুর কথা খুব বেশি করে মনে পড়ছে। আপু বয়সে আমার থেকে বছর দু’একের বড় হবে। গায়ের রং শ্যামলা। মাথায় কুঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল। মুখটা গোলাকার। ঠোঁটের কোনায় একটুখানি হেসে উঠত। লম্বা টানা টানা চোখ। মাঝারি স্বাস্থ্য। শান্ত। মৃদুভাষী। নম্র ও ভালোমানুষ। ব্যাচ এতটুকুই।
আপুর সবথেকে সুন্দর ছিল তার চোখদুটো। আমার বন্ধু সুমন বলত, দোস্ত, চোখ দেখে মেয়েদের প্রেমে পড়িস নে। বাঙালি মেয়েদের চোখ এমনিতেই সুন্দর হয়। আপুর চোখ তার থেকেও বেশি সুন্দর ছিল। সে চোখের দিকে তাকালে যে কেউ মুগ্ধ হতো।
মেয়েরা এমনিতেই বয়সের থেকে বেশি বড় হয়ে যায়। বুদ্ধিতে, ব্যক্তিত্বে আরো না জানা অনেক কারণে। আপুও বড় হয়ে গিয়েছিল। দু`বছরের বড় খুব বেশি বড় নয়। এমন বড় ছেলেদের সাথে হামেশাই বন্ধুত্ব হয়। তাতে কারো খুব বেশি অসুবিধা হয় না। এটা নিয়ে কেউ মাথাও ঘামায় না।
তবে দু`বছরের বড় মেয়েদের সাথে বন্ধুর হওয়া দুষ্কর। তাদের কাছে নিজেদের বড্ড ছেলেমানুষ মনে হয়। অপরিপক্ক মনে হয়। এমনকি শৈশব-কৈশোরের মাঝের সময়টাতে মাঝে মাঝে নির্বোধও মনে হয়।
ছেলেবেলায় আপুর সাথে খুব বেশিদিন দেখা হতো না। আপু থাকত আঙ্কেলের চাকরির শহর খুলনাতে। ছুটিতে বাড়ি আসলে দেখা হতো। একটু বড় হলে খেলাধুলা আর হতো না। দু`একটা কথা হতো। আপু দু`ক্লাস উপরে পড়ত। সেই ক্লাসের বই নিয়েও কথা হতো।
এরপর প্রায় বছর চার-পাঁচ আর দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। দীর্ঘদিন পর যখন দেখা হলো, তখন আপু ভার্সিটিতে সদ্য অ্যাডমিশন করিয়েছে। আমি এসএসসি দিয়েছি। তখনো বইপড়ার অভ্যাস ছিল। টুকটাক লিখতামও। আপুর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমি বললাম, আপনার গল্পগুচ্ছের কোন গল্পটি বেশি ভালো লাগে? আপু লজ্জা লজ্জা মুখ করে ঈষৎ হেসে বলল, `সমাপ্তি`। গল্পের নামটি বলার পড়েও সেই লজ্জা মেশানো হাসিটি ঠোঁটের কোনায় রয়ে গেল।
গল্পটি পড়তে আমার তুমুল আগ্রহী জন্মাল। আপুর সাথে কথা হচ্ছিল সন্ধ্যার একটু আগে। আপুর বাসার সামনে। তখন প্রকৃতিতে হালকা আলো, হালকা অন্ধকার। আপু আলো পুরোপুরি কমে এলে বাসায় ঢুকে গেল।
আমি কালবিলম্ব না করে মামার বাড়ি রওনা হলাম। আমার মামার বাড়ি একই গ্রামে। এপাড়া ওপাড়া। মামার বাড়ি গিয়ে সোজা ছোট মামার ঘরে। ছোট মামার একটা গল্পগুচ্ছ ছিল। দিদিমাকে বলে সেটা নিয়ে সোজা বাড়ি চলে এলাম।
রাতেই সমাপ্তি পড়া সমাপ্ত হলো। সমাপ্তির শেষ দৃশ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ভগ্নী চলিয়া গেলে অপূর্ব অন্ধকারে সাবধানে খাটের অভিমুখে গেল। খাটে প্রবেশ করিতে উদ্যত হইতেছে এমন সময়ে হঠাৎ বলয়নিক্বণশব্দে একটি সুকোমল বাহুপাশ তাহাকে সুকঠিন বন্ধনে বাঁধিয়া ফেলিল এবং একটি পুষ্পপুটতুল্য ওষ্ঠাধর দস্যুর মতো আসিয়া পড়িয়া অবিরল অশ্রুজলসিক্ত আবেগপূর্ণ চুম্বনে তাহাকে বিস্ময়প্রকাশের অবসর দিল না। অপূর্ব প্রথমে চমকিয়া উঠিল, তাহার পর বুঝিতে পারিল, অনেক দিনের একটি হাস্যবাধায়-অসম্পন্ন চেষ্টা আজ অশ্রুজলধারায় সমাপ্ত হইল।
শেষ কথাটি পড়ার পরে বুঝলাম, তখন শিউলি আপু মুখটিপে হাসছিল কেন? কেনই বা লজ্জা পাচ্ছিল। তখন আপুরও বিয়ে হয়নি, আমারও বিয়ে হয়নি। গল্পটি পড়ার সময় মনে মনে আমি অপূর্বর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে নিয়েছিলাম। কল্পনায় মৃণ্ময়ী রূপে কে তখন এসেছিল, এতদিন পরে তা আজ আর মনে নেই। আপুও নিশ্চয় গল্পটি পড়ার সময় নিজেকে মৃন্ময়ীর জায়গায় দেখতে পেয়েছিল। আপুর চোখে অপূর্ব হিসেবে কে এসেছিল তা আমার জানার বাইরে। নিশ্চয় কেউতো এসেছিল। তাই অমন লজ্জা জড়িয়ে ছিল মুখে ও ঠোঁটের আগায়।
সরাসরি গল্পগুচ্ছ থেকে পড়া আমার প্রথম গল্প `সমাপ্তি`। আজ আবার সমাপ্তি পড়লাম। কী যে ভালোলাগা মিশে আছে গল্পটিতে, যে না পড়বে, সে বুঝবে না। সমাপ্তি পড়ে বহুবছর পূর্বের সেই কিশোরকালের কথা আবার স্মৃতির পাতায় উঁকি দিল। এক প্রকার ভালোই হলো। কিছুক্ষণের জন্য সেই দামাল সময়টাকে তো ফিরে পেলাম।
২৩ এপ্রিল ২০২০
























