অমিতাভ পালের গদ্য ‘উড়বার ডানা’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৯

হয়তো পালাতে গিয়েই উড়তে না জানা কোনও একটা প্রাণী উড়তে চেয়েছিল। হয়তো লাফ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একবার বেঁচেও গিয়েছিল। তারপর হয়তো বারবার লাফ দিয়েই উড়ে পালাতে চাইতো সে। তার স্বজাতিরাও হয়তো তাকে দেখে বুঝতে পেরেছিল, এটাই পালানোর শ্রেষ্ঠ উপায়, এই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়াটা। তারাও হয়তো তাই উড়তেই চাইতো, চাইতো ধরাছোঁয়ার বাইরে যেতে। কিংবা কোনও প্রাণী হয়তো উঁচু গাছের মগডালে ঝুলতে থাকা কোনও সরস ফলের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সেখানে যেতে চাইতো সে এবং সেই মগডাল থেকে আরো আরো সরস ফলের মগডালে। তার স্বজাতিরাও হয়তো তার কাছ থেকে শিখেছিল মগডালের সরস ফলের স্বপ্ন দেখতে।

তারপর চললো নিরন্তর চর্চা। তা সে পালানোর জন্যই হোক বা সরস ফলের প্রেম। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলা এই বাঁচা কিংবা পেট ভরানোর স্বপ্ন একদিন ওই প্রাণীটার কোনও এক প্রজন্মের হাতদুটিকে পাখা বানিয়ে দিল, তাকে ভাসিয়ে দিল আকাশে। এখন সে পালাতে পারে কিংবা পারে সরস ফলের স্বাদ নিতে। এখন সে পাখি।

আকাঙ্ক্ষা একটা ব্যক্তির মনে জন্মানো এক মহত্তম শিশু। ব্যক্তির চোখ দিয়েই সে দেখে এই পৃথিবীটাকে, বোঝে, টের পায় তার ইচ্ছাগুলিকে এবং একদিন সে উপায় ঠিক করে ফেলে। তারপর শুরু করে উপায়টাকে আয়ত্বে আনার চেষ্টা। সম্ভাবনার ফলপ্রসূতা ওই চেষ্টাকে অন্যদেরও চেষ্টায় পরিণত করে। আর সবাই তাদের এই চেষ্টার বীজটাকে বুনে দিয়ে যায় তাদের সন্তানের মনে। আকাঙ্ক্ষা বড় হতে থাকে এবং একসময়, হয়তো তা হাজার কিংবা লক্ষ বছর পরে পাখা হয়ে ফোটে। আর কোনও প্রাণই যেহেতু একা নয়, একটা প্রজাতি, তাই পাখাটা হয়ে যায় সবার। কোনও এক ব্যক্তির মনে জন্মানো একটা মহত্তম শিশু এইভাবে সবার হয়ে ওঠে।

এটা প্রাকৃতিক বিবর্তন। এখানে প্রকৃতির দেয়া শিক্ষা প্রাণীরা অন্ধভাবে অনুসরণ করে। কিন্তু সেই প্রাণ যখন মানুষ হয়ে ওঠে, তখন সে এর কারণ খুঁজতে চায়, জানতে চায় এর নিয়ম। আর নিয়ম জেনে ফেলার পরে সে আরো গূঢ় নিয়ম তৈরি করে বিষয়টা তার আয়ত্বে নিয়ে আসার জন্য। তৈরি করে আকাঙ্ক্ষা পূরণের বিকল্প পদ্ধতি। তাই সে আর শরীরে ডানা গজানোর চেষ্টা না করে বানিয়ে নেয় এরোপ্লেন কিংবা সিঁড়ি। আকাশ কিংবা মগডাল আর তার নাগালের বাইরে থাকে না।

যন্ত্র দিয়ে শারীরিক সীমাকে অতিক্রম করা গেলেও মনের সীমাকে অতিক্রম করা বেশ কঠিন। ফলে মানসিক বিবর্তন যন্ত্রসাধ্য না হয়ে হয় অভ্যাসসাধ্য কিংবা সাধনাসাধ্য। মনের সবচেয়ে বড় শক্তি এবং সমস্যা বাইরের প্রভাব। এমনিতে প্রকৃতি এবং পূর্বজদের কাছ থেকে মানুষের দেহ কিছু শিক্ষা পায়। আত্মরক্ষা, খাদ্যগ্রহণ, প্রজনন তাদের অন্যতম। এইসব শিক্ষা অন্যান্য প্রাণীদের মতোই তারও জন্মগত। কিন্তু মানুষের জীবনতো আর অন্য প্রাণীদের মতো খাওয়া, ঘুমানো এবং যৌনতায় সীমিত না, শরীরসর্বস্বও না, তাই আশপাশের প্রভাব খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রভাবগুলির মধ্যে আছে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, ভীতি, লোভ ইত্যাদি। এর সবগুলিই মানুষ তৈরি করতে এবং শিখতে ও শেখাতে পারে।

সমাজ যেহেতু মানুষের জন্য, তার টিকে থাকার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই আশপাশের প্রভাব সমাজ গঠনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ টিকে থাকার জন্য যে ধরনের সমাজ দরকার, সেটা তৈরি করতে প্রভাব খুব বড় হাতিয়ার। ইতিহাসে এর নজির বহু আছে। বহু সমাজ আমরা তৈরি করেছি এবং করছি আমাদের সুবিধার জন্য এবং এইসব সমাজ আবার ভেঙেও দিচ্ছি একই কারণে। প্রধানত শক্তির পাল্লা যেদিকে ভারি, তাদের প্রভাবেই সমাজ তৈরি হয়। অর্থাৎ প্রভাবের সাথে শক্তির একটা সম্পর্ক আছে। এই শক্তিই ঠিক করে কোন জ্ঞান, কোন অভিজ্ঞতা, ভীতি কিংবা লোভ প্রভাব হিসাবে সমাজে ক্রিয়াশীল থাকবে।

শক্তি বিভিন্ন রকম। সংখ্যা কিংবা সম্পদ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে শক্তির রকমফের ঘটায়। বিজ্ঞানে তাপশক্তি যেভাবে যান্ত্রিক শক্তিতে বদলে যায় এবং বিভিন্ন মেশিন চালায়, সেই নিয়মেই সামাজিক শক্তিও বদলায়। সমাজের মেশিন চালায়। তাপশক্তির উৎস কয়লা বা পেট্রোলিয়ামের মতো আলাদা হলেও তাপের চরিত্র একই থাকে, কিন্তু সামাজিক শক্তির চরিত্র নির্ভর করে তার উৎসের ওপর। অর্থাৎ সংখ্যা বা সম্পদের চরিত্র আলাদা হলে শক্তির চরিত্রও হবে আলাদা। অসাধু সংখ্যা বা সম্পদের শক্তি অসাধু, সাধু সংখ্যা বা সম্পদের শক্তি সাধু। শক্তির এই আলাদা চরিত্র সমাজের মেশিনেও তৈরি করে আলাদা গতি। অসাধু শক্তি সমাজকে পিছনের দিকে নিয়ে যায়, আর সাধু শক্তি সমাজের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করে।

অর্থাৎ প্রভাব নিয়ন্ত্রণেরও ক্ষমতা আছে শক্তির। কিংবা বলা যায় শক্তিরই গন্ধের নাম প্রভাব। নাকটা একটু বাড়িয়ে ধরে চারপাশ শুঁকলেই প্রভাবের গন্ধ পাওয়া যায়। আর তখন বোঝা যায় শক্তির চরিত্রও।

নিজের মনের মধ্যেও এই গন্ধটা থাকে। আমিতো সমাজেই থাকি, তাই। আর এখানেই অভ্যাস কিংবা সাধনার কথা আসে। যে প্রভাবের গন্ধ আমার মনে, আমার চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে, তাকে যাচাই করার ক্ষমতা অর্জন করা যায় অভ্যাস কিংবা সাধনার মাধ্যমে। এই প্রভাব আমাকে বিচ্ছিন্ন করছে নাকি সম্মিলিত করছে, সেটা জানা খুবই জরুরি। তা না-হলে আমার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা চলে যাবে অন্যের হাতে, আমি নিয়ন্ত্রিত হবো পুতুলের মতো, আমার ইচ্ছা বলতে আর কিছুই থাকবে না এবং আমি হারিয়ে যাব আমার কাছ থেকে। নিজেকে হারিয়ে ফেলা একটা জীবন কাটানো খুবই দুঃসহ। তাই সম্মুখিন হওয়া যেকোনো কিছুকে যাচাই করতেই হবে।

যাচাই শুধু নিজের জন্যই না, বরং যাকে যাচাই করছি তার জন্যও প্রয়োজন। অর্থাৎ যাচাইয়ের ভিতর দিয়ে আমি যেমন খুঁজে পাই আমার গন্তব্য, তেমনি যাকে যাচাই করছি, তার চরিত্রও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মানুষ যেমন উন্নত হতে শিখেছে, তেমনি অবনতির শিক্ষাও অর্জন করেছে সে। এই শিক্ষা আত্মস্বার্থের কাজে ব্যবহার করার জন্য সে নানা কৌশল খাটায়। যাচাই এই কৌশলগুলির পোশাক সরিয়ে বের করে আনে আত্মস্বার্থের নগ্ন চেহারা। আর আমরা টের পাই, আমরা কোনদিকে যাচ্ছি।

ব্যক্তির যাত্রা কেবল ব্যক্তিরই থাকে না মানবসমাজে। যাত্রার চরিত্র কিংবা রূপরঙ যাই হোক না কেন, সামাজিক প্রভাবের কারণে তা হয়ে ওঠে সকলের। আর যখনই তা সকলের হয়ে ওঠে, তা পরিণত হয় জ্ঞানে। অর্থাৎ জ্ঞান হলো ব্যক্তিঅভিজ্ঞতার সম্মিলিত রূপ। কোন ব্যক্তিই কোন বিচ্ছিন্ন সত্তা না বরং সমাজের নির্যাস। ফলে তার একক যাত্রাও সমাজের শক্তিতে চলে, যেন কেউ কোথাও যেতে চাইলে সমাজ তাকে ঠেলে দেয় সেদিকে। অর্থাৎ কেউ ধর্মের পথে হাঁটতে চাইলে সমাজের ধর্মীয় শক্তিগুলি যেমন তাকে ঠেলতে থাকে, তেমনি কেউ নাস্তিকতার দিকে যেতে চাইলেও সমাজের যুক্তিশীল অংশ তাকে ঠেলতে থাকে পিছন থেকে। আর এই ঠেলার কাজে সমাজকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে সমাজে সঞ্চিত জ্ঞান। মানবসমাজ আর কিছু জমাক না জমাক, জ্ঞানকে সে জমিয়ে রাখে অতি আদরে।

এই জ্ঞানই আমাদের উড়বার শক্তি, আমাদের পাখা। আমাদের সব আকাঙ্ক্ষার মূর্ত রূপ। আজ যদি কোন কারণে আমাদের পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়, তাহলে রকেটে উঠবার সময় আমরা কিন্তু বালিশ-কাঁথা-হাড়ি-খুন্তি নিয়ে উঠবো না, উঠবো জ্ঞান নিয়ে। কারণ আমরা যেখানেই যাই না কেন, আমাদের সঙ্গে নেয়া জ্ঞানই আবার সেই জায়গাটাকে আমাদের উপযোগী করে তুলতে পারবে। ফলে জ্ঞানের চেয়ে বড় বন্ধু মানুষের আর নেই। চলুন, সবাই মিলে আমাদের অভিজ্ঞতাগুলিকে জ্ঞানে বদলে ফেলি।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক