অমিতাভ পালের গদ্য ‘কবিতা নিয়ে কয়েকটা কথা’

প্রকাশিত : আগস্ট ১৭, ২০১৯

কবিতার বোধহয় কখনো অস্তিত্বের সংকট হয়নি। অথবা তার ব্যর্থতা, জীবনের বহু ক্ষেত্রেই যে শব্দটি খুব গতানুগতিক। কিন্তু এই বোধ মনে এইজন্যই জাগে যে, সংকট খুব সর্বগ্রাসী। জীবনের গভীরতম নগ্নতার মধ্যে অজস্র রোগজীবাণুর মতো হয়তো।

খুব প্রাচীন কালকে যদি বিবেচনায় রাখি, যদি মনে করি চেতনা বিকাশের প্রাথমিক স্তরেই শিল্পের জন্ম হয়েছিল, তাহলেও কবিতা বহুদিনের। অর্থাৎ একটি সুপ্রাচীন অভিজ্ঞতার নির্যাস কবিতায় আছে। যখন প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো এই নির্যাসের পুকুরে ডুব দিয়ে কবি তুলে আনেন সুশীতল কাদা যা ধারণ করে আছে সভ্যতার সমস্ত শুচিবায়, কবিতার শক্তিমত্তা চোখে পড়ে। শক্তিমত্তাই, কারণ একটি নিভৃত জীবন যা কল্পনার বাসে চড়ে পেরিয়ে যায় ইতিহাসের সকল অধ্যায়, শক্তির সামর্থ্য।

কবিতা এই শক্তির সাহায্যে টিকে আছে। যেন দেহরক্ষী, অজস্র অরুচিকর উল্লাসের মধ্যে একটা গোপন অস্বস্তির চারদিকের নির্জনতার মতো। অর্থাৎ খুব গোপন। কবিতা একটা অণুজীবের মতো এইসব অরুচিকর উল্লাসকে আক্রান্ত করে, বুঝিয়ে দেয় অসুস্থতার মাত্রা। আর জীবন সম্বন্ধে আশাবাদী কোনো একজন হয়তো জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কবি হয়ে ওঠে। কবিতা টিকে যায়।

অর্থাৎ কবিই। অজস্র বইভর্তি আলমারির মধ্যে একটা সিলভারফিশ পোকার মতো যেন। চারদিকে এত অক্ষর, এত পৃষ্ঠার চাপ একটা নরম তুলতুলে পোকাকে কি আশ্চর্যভাবেই না রক্ষা করে।

কবি চিন্তার মধ্যে টেকেন। স্বতঃস্ফূর্ত, কল্পনাপ্রবণ, সঙ্গতিময় এক চিন্তা। আর এই টিকে থাকা এক আবহমান প্রক্রিয়ার মধ্যে সময়ের মতো যেন। কেননা কবিতা আবহমান হলেও কবির পার্থিব জীবন কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই থাকে। সেটা তার কাল। কবি তার কালকে আবহমানতার সাথে যুক্তই করেন শুধু। যেন ক্রমশ যুক্ত হচ্ছে বগি, আরামদায়ক, প্রথম শ্রেণির। অবশ্য তার তৈরি হওয়ার একটা ইতিহাসও আছে। কারখানার ইতিহাস। যেন একটা জীবন অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতের সাথে ক্রমশ সম্পৃক্ত হচ্ছে। উপযুক্ত হচ্ছে। এই উপযুক্ততার যাথার্থ্য নির্ভর করে ধারণক্ষমতার ওপর। কবিতার বিশাল আয়তন যা সময়ের মাটির সংযোগে ক্রমশ স্ফীত, তা ধারণ করা। এক গভীর অলক্ষ্য ভার কবির জীবনে গোপন ঘামের জন্ম দেয়।

বাংলা কবিতা, যদিও কবিসম অনেক চেষ্টাকারীর জন্ম এই ভাষা দিয়েছে, বিভিন্ন সময়ের কবির ভারবহনের জন্য এখনো প্রবহমান। আগামী দিনগুলিতেও তাই হবে। আমাদের হয়তো অনেক অনেক স্মৃতিকোষসহ একটি কম্পিউটারেরর প্রয়োজন হবে আজ পর্যন্ত প্রকাশিত সকল বাংলা কবিতা সংরক্ষণে। কিন্তু কবিতার অগ্রগামিতা মুষ্টিমেয় কবির রচনাতেই থাকে। যেন প্রত্নতাত্ত্বিকের খনন, অজস্র এলোমেলো গুপ্তধনপ্রতীম বস্তু হয়তো মেলে কিন্তু অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সঠিক বস্তু চিহ্নিত করে এবং তা দিয়েই শনাক্ত হয় একটি সভ্যতার গতিপ্রকৃতি। কবিতার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এইরকমই।

অর্থাৎ কবিতা হচ্ছে শিল্পের সেই সূক্ষ্মতা যা সভ্যতার অগ্রসরমান অবস্থাকে মাপতে পারে। আর কবিতা পড়ে আমরা তা বুঝি।

মাইকেল মধুসূদনের সময় বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার শুরু হয়েছিল, আজ তার নিশ্চয়ই এমন একটা অবস্থা হয়েছে যা খুব সূক্ষ্ম আর নতুন। কবিতা নিজেই এর জন্য দায়ী। অন্তত কিছুকিছু ক্ষেত্রে উদাহরণের ধারাকাহিকতা লক্ষ্য করা কঠিন না। পৃথিবীর সমস্ত হতাশার মধ্যেও কবিতা লিখিত হচ্ছে এবং আরো হবে। প্রতিবার বর্ষা মৌসুমের মতো হয়তো।

আধুনিক কবিতা এইক্ষেত্রে সমকালীন, বিগত কবিতাকে বহন করে এনেছে। এটি বোঝা যায় দুই সময়ের কবিতার মধ্যে একটা গভীর মিল লক্ষ্য করে। যেন প্রতিটা মানুষের প্রাণীত্বের মিল, যেন যৌনতার মতো। কবিতা শনাক্তকরণেরও মিল এটিই। অনেক অকবিতার ভিড়ে হৃষ্টপুষ্ট ভেড়ার মতোই তাকে চেনা যায়। অবশ্য ব্যাপারটা নির্মমও। পরিপূ্র্ণভাবে চোখ খুললে অকবিতার রাজত্ব প্রতিষ্ঠার আপ্রাণ চেষ্টা যে চোখে পড়বে না তা নয় কিন্তু তারপরও কবিতার অক্লেশে প্রতিষ্ঠা— হয়তো তা কিছু রঞ্জিত হৃদয়ের গভীরে, দেখে এই কথা মনে হয়।

সমকালীন কবিতার ক্ষেত্রে আবহমানতার এই মিল লক্ষ্য করে হৃদয় আনন্দিত হয়। অর্থাৎ আবার কবির জন্ম হচ্ছে। কোনো এক ধূসর বিকেলে অজস্র বিগত কবিদের মতো এই সমকালীন কবিও হয়তো বিগত আরেক কবি হবে একদিন কিন্তু এইমূহূর্তে সে রাজা।

বনরক্ষকের মতো খুব নিবিষ্ট হয়ে এই জন্মকে লক্ষ্য করা যায়। যেন গভীর বনের মধ্যে হঠাৎ একফালি সূর্যালোকের নিচে একটা শিশু উদ্ভিদ। তার আশ্চর্য নরম পাতায় আবহমান সবুজ ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে।

কবিতার তথাকথিত দীর্ঘশ্বাস হিসাবে এতদিন যা প্রচলিত— অকবিদের অবিস্মরণীয় যৌথনৃত্য— তা অবশ্য নতুন কবিতাকে ধরতে পারবে না। ধরতে পারবে না কারণ নিজের কবিতা হয়নি— এই শোকে তারা আচ্ছন্ন। আর নিজে না পারলে যে ব্যর্থতা জন্মে তা খুব অন্ধ— পরশ্রীকাতরও হয়তো। একটা ব্যর্থ মানুষের যন্ত্রণাকে তখন বোঝা যায়। আর কবিতা এক্ষেত্রেই সবচেয়ে নির্মম। ক্ষমাহীন বিচারকের মতো।

কবিতার এই বিশুদ্ধতা আছে। অন্যান্য জ্ঞানের ক্ষেত্রেও এই বিশুদ্ধতা চোখে পড়ে। এটাই বাহুল্যকে ছেঁটে ফেলতে পারে। কবিতা তাই সবসময় আশ্চর্যরকম বাহুল্যহীন।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক