আল মাহমুদ ও নির্মলেন্দু গুণ

আল মাহমুদ ও নির্মলেন্দু গুণ

আওয়ামী লীগ কবি ও জামায়াত কবি

তুহিন খান

প্রকাশিত : মে ০৩, ২০২০

নির্মলেন্দু গুণরে নিয়া লেখায় অনেক জ্ঞানীগুণী লোকেরা যে বেজার হইছেন, বুঝতেছি। জ্ঞানীগুণীদের বেজার মুখগুলি দেখতে খারাপ লাগে না। নির্মলেন্দু গুণের মতো নিজেরে লীগ দাবি করার মতো ঔদ্ধত্য যে অন্তত এনাদের এখনও হয় নাই, সেজন্য অবশ্য শোকরিয়া আদায় করা দরকার। এই সুযোগে কেউ কেউ আবার আল মাহমুদরে নিয়া টানা হেঁচড়া করতেও ছাড়ে নাই। বহুদিন পরে যেহেতু সুযোগটা পাওয়া গেছে, ফলে পূর্ণ সদ্ব্যবহার। তাদের কথামতে, আল মাহমুদ খুবই অসৎ একজন মানুষ, যে নিজের পলিটিকাল আইডেন্টিটি লুকাইছেন।

তাইলে আমরা একটু হিস্ট্রির দিকে তাকাইতে পারি। আল মাহমুদ আর গুণের বয়সের ডিফারেন্স খুব বেশি না। স্বাধীনতার পরে দুইজনই বাংলাদেশে কবিতা লিখছেন। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার, দুইজনের রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিজমের ধরন একই রকমের ছিল না। আল মাহমুদ গণকণ্ঠের জন্য জেলে গেছিলেন, গুণ কখনোই এমন কিছু ফেস করেন নাই। গুণের পলিটিকাল অ্যাক্টিভিজম কবিসুলভ ছেলেমানুষীর অধিক কোনও মূল্য, প্রায় কারুর কাছেই পায় নাই। এমনকি, বিএনপি-জামাত বা এরশাদের আমলেও নির্মলেন্দু গুণের বিশেষ কোনও সমস্যা হইছিল কী? নির্মলেন্দু গুণ নিজে জবানবন্দি দিতেছেন, জিয়ার আমলে উনি বাংলা একাডেমিতে মুজিবরে নিয়া লেখা কবিতা পড়ছেন, দুই দুইবার। কই, তার কোনও বিপদের কথা তো আমরা শুনি না।

সাথে আরো একটা তথ্য যোগ কইরা রাখতে পারেন। নির্মলেন্দু গুণ বাংলা একাডেমি পান ১৯৮২ সালে। তাইলে হয় এরশাদ সরকার কবি-সাহিত্যিকদের অন্তত এই সরকারের চাইতে উদার মনে মূল্যায়ন করতেন, আর নাইলে গুণদার সরল স্বীকারোক্তিতে ভেজাল আছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা এই, নির্মলেন্দু গুণরে পলিটিকালি কোন সরকারই খুব সিরিয়াসলি নেয় নাই। অন্তত হিস্ট্রিতে এর নজির দেখি না।

তাইলে দেখা গেল, যারা গুণের `সততা`র বিপরীতে আল মাহমুদের `অসততা`র বয়ান তৈয়ার করতে লাগছেন, তাদের বক্তব্য এত সত্য না। গুণদার পলিটিকাল ক্যারিয়ারেও অন্তত সচকিত হওয়ার মতন বৈচিত্র্য আছে। তাছাড়া `রাজাকারদের পত্রিকা`য় গুণদার লেখালেখির ঘটনাও তো এখনও আওয়ামী-শাহবাগীদের জন্য সবিশেষ অস্বস্তির কারণ। আল মাহমুদের পলিটিকাল অ্যাক্টিভিজমের কারণে তার যেভাবে রাষ্ট্রের তরফে বিপদের মুখে পড়তে হইছে, স্বাধীন বাংলাদেশে, গুণদার তেমন কোনও বিপদও ঘটে নাই।

আল মাহমুদের রাজনৈতিক মতাদর্শ কি অসততা ছিল? আল মাহমুদ খুল্লাম খুল্লা তার মতাদর্শ প্রচার করছেন, এমনকি কবিতায়ও নিজের মতাদর্শ প্রচার কইরা গেছেন। একজন মানুষের জীবনের বোধ বা উপলব্ধির ক্রমিক বিবর্তনরে কেউ যদি সুবিধাবাদ কন, তাইলে মানুষের পর্যায়ক্রমিক মানসিক বিকাশের যে রাস্তা সেইটা খোলা থাকে কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার।

আল মাহমুদ সমাজতন্ত্রী যখন ছিলেন, তখন জেল খাটতে হইছে তার সমাজতন্ত্রের জন্য। জেলে গিয়া আল মাহমুদের ভেতরে ধর্মের প্রতি আগ্রহ তৈয়ার হইছে। মনে রাখা দরকার, আল মাহমুদ সোভিয়েত ভাঙার পরে অনেক সুবিধাবাদী বামের মতন ধীরে ধীরে সটকে পড়েন নাই। উনি সোভিয়েত রাশিয়ার প্রবল প্রতাপের সময়টাতেই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস হারাইছিলেন। সেইটা কোনও দোষ না অবশ্যই।

আল মাহমুদ বিভিন্ন সরকারের সময় তাদের সাথে ছিলেন, তাদের কাছ থেকে সুবিধা নিছেন— আমার জ্ঞানী বন্ধুদের এই বয়ানই তো প্রমাণ করে যে, তিনি জামাত ছিলেন না। তিনি সব সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিছেন, জামাত সরকারের কাছ থেকেও নিছেন। বঙ্গবন্ধুই প্রথম তারে বুঝায়ে দিছিলেন, একজন কবির সরকারভক্ত হইতে হয়। তার বিপ্লবী হওয়া চলে না। সেই সবকই আল মাহমুদ মাইনা আসছেন সবসময়। নিজের সব বিশ্বাস তিনি পষ্টই ঘোষণা দিছেন, এমনকি জিয়ারে স্বাধীনতার ঘোষকও বলছেন; নিজেরে খুল্লাম খুল্লা জামাত বলায় তার এমন কি অসুবিধা ছিল, তা বোধগম্য না। যেহেতু ততদিনে জিয়াও প্রায় রাজাকারেই পর্যবসিত হইছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলায়।

কিন্তু আল মাহমুদ কখনও তা বলেন নাই। কারণ, তিনি ধর্মীয় ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন, জামাতের দলীয় কবি কখনোই ছিলেন না। সেইটা জামাতও হয়ত দাবি করে না এখন আর। মজার ব্যাপার, এরকম `জামাতের কবি`র লিস্টটা কিন্তু অনেক বড়। ফররুখ, আল মাহমুদ, তালিম হোসেন, আশরাফ সিদ্দিকী, এমনকি হালের সাইয়েদ জামিল— প্রত্যেককেই জামাতের কবি তকমা দেয়া হইছে। এমনকি, এই তথ্য উল্লেখের লোভ সামলাইতে পারতেছি না যে, জীবনানন্দ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ও কবি মাহবুবুল হক শাকিল পুরষ্কার পাওয়া কবি রাসেল রায়হানরেও, তার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত কেউ কেউ জামাতি বা মৌলবাদী কবি বইলা ট্যাগ লাগাইতে চাইছেন! এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে `জামাতের কবি` টার্মটা জামাত করা-না করার সাথে সম্পৃক্ত না।

এর সম্পর্ক আরো গভীরে, এদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেক গভীরে যে কলকাত্তাই সাম্প্রদায়িকতার বীজ বোনা আছে, তার সাথে। আল মাহমুদ জামাত ছিলেনই হয়তবা। মাইনা নিলাম। কিন্তু, গুণ নিজেরে দম্ভের সাথে আওয়ামী লীগের কবি ঘোষণা দিয়া আপনাদের উদার হৃদয়ে যে সততার জয়মাল্য পাইছে, আল মাহমুদ নিজেরে খুল্লাম খুল্লা জামাত বললে, জামাতের হইয়া নির্বাচন করতে চাইলে, সেই জয়মাল্যের দুই একটা ফুলও পাইতেন কী? আল মাহমুদের `কাবিলের বোন` ছাপা হওয়ার পরে ১৯৯২ এর বইমেলায় তার স্টলে হামলা হইছিল। উনি নিজেরে জামাত ঘোষণা করলে আজ হয়ত উনি জেলেই মরতেন, হু নোজ!