প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

আলাপগুলা রসালো, পইড়া মনে হয় বিয়া করা দরকার

তুহিন খান

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২১, ২০২০

ইদানীং ইসলামি বইয়ের মার্কেটে দাম্পত্যজীবন সম্পর্কিত বইপত্রের বেশ রমরমা অবস্থা। বায়তুল মোকাররমের বইমেলা থিকা `নবীজির দিনলিপি` নামে একটা বই কিনছিলাম। দোকানে থাকা ভদ্রলোক বললেন, নবীজির দাম্পত্যজীবন নিয়া একটা বই আছে, ওইটা বেশি চলতেছে নাকি। আমি বললাম, বিয়া করলে কিনব নে, আমি তো ব্যাচেলর।

দাম্পত্যজীবন নিয়া লেখা বইপত্র চিরদিনই বেস্টসেলার, এইটা নতুন কোনও ঘটনা না। চোখ ফোটার পরে বাসায় প্রথম যে বইটা দেখছিলাম, সেই বইয়ের নাম— স্বামী-স্ত্রীর মধুর মিলন। এবং আমি নিশ্চিত, আপনারা অনেকেই উত্তরাধিকারসূত্রে এই বইয়ের একটা কপি হইলেও দেখছেন। অবশ্য ওই বইগুলার মলাট ছিল ময়লা, লাল কটকটা প্রচ্ছদ, ভেতরে জন্ডিস রোগীর পেচ্ছাপের মতো হলুদ হলুদ পৃষ্ঠা। লেখকের নামের নিচে দুই তিনটা ডিগ্রি লেখা থাকলেও, সেগুলা আসলে কী ডিগ্রি, বোঝার উপায় ছিল না।

বিষয়বস্তুও ছিল তথৈবচ। প্রথম অধ্যায়ে থাকত নারী-পুরুষ সৃষ্টির রহস্য। দ্বিতীয় অধ্যায়ে নারী ও পুরুষের প্রকার-প্রকৃতি। পদ্মিনী, হস্তিনী ইত্যাদি জাতীয় নারী; বৃষ, অশ্ব ইত্যাদি জাতীয় পুরুষের ডেফিনেশান থাকত। কোন জাতের সাথে কোন জাতের মিলন মধুর— এইসব রেসিস্ট আলাপ থাকত। এই দুই চ্যাপ্টারের কন্টেন্টে কোরান-হাদিসের রেফারেন্স খুব বেশি থাকত না; ভারতীয় দর্শন, হিন্দু পুরাণ, বেদ-গীতা, রাশিচক্র ইত্যাদির আলোকে নারী-পুরুষের প্রকার-প্রকৃতির পুরাপুরি সেক্যুলার একটা বয়ান থাকত। এর পরের অধ্যায়গুলায় থাকত একটা বাচ্চার ছোট থেকে বড় হওয়া, বিয়া করা, বাসর ঘরের বর্ণনা, বাসর ঘরের কনভার্সেশান ও করণীয় ইত্যাদি।

বইয়ের ভাষা হইত সাধু। এবং সাধারণত গ্রামের লোকজনই ছিল এইসব বইয়ের টার্গেট অডিয়েন্স। যদিও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পাল্টাইছে, ধর্ম ও বিয়া নিয়া বোঝাপড়াও পাল্টাইছে, পাল্টাইছে লেখালেখি ও প্রকাশনা জগৎও— কিন্তু বিয়া নিয়া মানুষের ভয়ডর পাল্টায় নাই। ফলে বিয়াশাদি সংক্রান্ত বই এই আরবান মার্কেটেও বেস্ট সেলার।

এখনকার বইগুলার নাম বেশ আধুনিক। লাভিং ওয়াইফ, আই লাভ ইউ, কুররাতু আইয়ুন ইত্যাদি। বিয়াশাদি সংক্রান্ত রিসেন্ট বইগুপত্রের অনেকগুলার নামই ইংরাজি বা আরবিতে, এইটা আমার পর্যবেক্ষণ। বাংলায় ইউনিক নামের এরকম বই আছে? জানাইয়েন।

তো, ইদানীংকালের বইগুলা দেখতে সুন্দর, প্রোডাকশন সুন্দর। ভিতরের কন্টেন্ট মোটামুটি কোরান-হাদিস বেজড, লেখকেরাও সবাই বেশ পরিচিত। বিয়াশাদি সংক্রান্ত বইগুলার এই বিবর্তন নিয়া সুন্দর একটা রিসার্চ হইতে পারে।

তবে সবচাইতে কার্যকর রিসার্চটা হইতে পারে এইসব বইয়ের কথোপকথন নিয়া। বিয়াশাদির বইয়ের একটা মেজর আইটেম হইল, জামাই-বউর আলাপ। এই নিয়া একটা চ্যাপ্টার থাকবেই। এই ক্ষেত্রে পুরান বা নতুন বইগুলার মধ্যে কোনও ফারাক নাই। সব বইয়েই জামাই-বউর মধুর আলাপের কিছু নমুনা আছে।

এই আলাপের প্যাটার্ন নিয়াও গবেষণা করা যায়। আগেরকালের বইগুলায় বউরা কিছু বলতোই না প্রায়, খালি এক্সপ্রেশন দিত। আর মাঝেমধ্যে মুখ খুললেও `হে প্রাণপ্রিয় স্বামীন` বইলা শুরু করত— যতবার মুখ খুলত, ততবার। আগের বইগুলায় জামাইয়ের মোটামুটি একটা ভাষণটাইপ থাকত, দুই-তিন পেজের। বাসরের প্রথম বা দ্বিতীয় রাইতে সে ওই ভাষণ দিত।

এখনকার বইগুলায় কনভার্সেশান বেশ মডার্ন, স্মার্টও বটে। বউ তো নাই, যেহেতু `লাভিং ওয়াইফ`; তো রিসেন্ট বইগুলায় ওয়াইফদের প্রচুর কথা বলতে দেখা যায়। আলাপগুলা এতই মধুর ও রসালো, পইড়া মনে হয় এইরকম আলাপ করার জন্য হইলেও বিয়া করা দরকার। আলাপগুলার প্যাটার্ন অনেকটা আধুনিক যুগের বফ-গফ আলাপের মতো, প্রেম ও নেকু নেকু কথাবার্তায় ভরা। এই গভীর প্রেমের ফাঁকে ফাঁকে মাঝেমধ্যে উইট, কোরান-হাদিস-ফেকাহ সংক্রান্ত আলাপ, গভীর জীবনবোধ এইসবও থাকে।

যাহোক, আজকে এইরকম একটা বই পড়লাম আরকি। তো, পইড়া মনে হইল— আসলে কি এই টাইপের আলাপ হয় নাকি জামাই-বউয়ের? হইলেও, কতটুক হয়? বা, এইসব আলাপ তো আসলে এক ধরনের মডেলও বাইন্ধা দেয় যে, আলাপগুলা এমন হওয়া উচিত। জামাই-বউর আলাপ তো দুনিয়ার সবচাইতে আনোখা আনকোরা আনপ্রেডিক্টেবল জিনিশ। এইটারে মডেলে বাইন্ধা দিলে হয় না আসলে। অনেক জামাই বা বউ আছে, যারা এইরকম চার্মিং, উইটি, মধু মধু, জ্ঞান-জ্ঞান আলাপ করতেই পারে না। ওই বেচারারা এইসব কনভার্সেশান পইড়া নিজেদের লাইফটারে হালকা একটু অসুখীই (বা ক্ষেত্রবিশেষে অনৈসলামিক) তো ভাইবা নিতে পারে, এমন মনে হইল আরকি।

এমনে, হেটাররা তো বলবে যে— আমার প্রেমিকা নাই, তাই হিংসা হয়।