ইসলামি চিন্তাবিদ আবুল হাশিমের আজ জন্মদিন

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৭, ২০২০

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও ইসলামি চিন্তাবিদ আবুল হাশিমের আজ জন্মদিন। ১৯০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের কাশিয়াড়ায় জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবুল কাশেম বর্ধমানের কংগ্রসের বিধায়ক নেতা ছিলেন।

বাংলাদেশের বামপন্থী বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমরের পিতা আবুল হাশিম। ১৯২৩ সালের বর্ধমান মিউনিসিপাল স্কুল থেকে আবুল হাশিম ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯২৫ সালে আইএ এবং ১৯২৮ সালের বিএ পাস করেন।

১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে বিএল ডিগ্রি লাভ করে বর্ধমান আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। আবুল হাশিম ১৯৩০ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম নেতা হিসেবে যোগ দেন।

মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে তিনি এর উদারপন্থী অংশ গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করেন। অনেক প্রগতিশীল বাঙালি মুসলিম তরুণকে তিনি উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি বর্ধমান থেকে নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বঙ্গীয় আইন সভায় সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৩৭ সালের মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৩৮ সালে তিনি বর্ধমান জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ও ১৯৪২ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালের ৭ নভেম্বর মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তানকে একটি অখণ্ড রাষ্ট্র হিসেবে দাবি না করে ভারতের উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছিল। সেই হিসেবে বাংলায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবার কথা। কিন্তু ১৯৪৬-এর নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৪৬ এর ৯ এপ্রিল দিকে দিল্লিতে আহুত মুসলিম লীগের নবনির্বাচিত বিধায়কদের সভায় মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্‌র পরামর্শে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেন।

মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্‌র এই প্রস্তাব উত্থাপনের পর বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম খুব দৃঢ়ভাবে এর বিরোধিতা করেন। এরপর ভাষাভিত্তিক স্বাধীন বাংলা গঠনের প্রচেষ্ঠায় আবুল হাশিম বাঙালি কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসুর সাথে দেখা করেন। এদিকে ভারতের ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের তার চিফ অফ স্টাফ লর্ড ইসম্‌কে ভারত বিভাগের ভিত্তিতে একটি পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন।

এ পরিকল্পনাটি প্ল্যান বলকান নামে পরিচিত। এই প্ল্যান বলকান অনুযায়ী, ভারতকে দুইয়ের অধিক অংশে বিভক্ত করার কথা হয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তানকে দুই অংশে বিভক্ত করা এবং এর যে কোনো অংশের অন্তর্গত কোনো প্রদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গঠিত হতে চাইলে তার ব্যবস্থাও এই পরিকল্পনার মধ্যে ছিল। কিন্তু কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহেরু ও কংগ্রেসের তীব্র বিরোধিতায় শেষ পর্যন্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা গঠনের সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে রোধ করে।

১৯৪৭ সালের ১০ মে আবুল হাশিম শরৎচন্দ্র বসুর সাথে মহাত্মা গান্ধীর সাথে তার সোদপুর আশ্রমে দেখা করেন। সেখানে আবুল হাশিম গান্ধীর নিকট সাধারণ ভাষা, সাধারণ সংস্কৃতি এবং সাধারণ ইতিহাস যা হিন্দু মুসলমান উভয়কে একসূত্রে আবদ্ধ করেছিল, তার উপর ভিত্তি করে `যুক্ত বাংলার` উপর তার বক্তব্য তুলে ধরেন।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ আইন সভায় বিরোধী দলের নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দেন। এরপর পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫২ সালে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকায় তিনি ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হন এবং প্রায় ১৬ মাস কারাভোগের পর মুক্তিলাভ করেন। এরপর থেকে তিনি খেলাফতে রাব্বানী পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ পার্টির সভাপতি ছিলেন।

আইয়ুব খানের শাসনামলে আবুল হাশিম ইসলামিক একাডেমির (যেটি বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন নামে পরিচিত) পরিচালক ছিলেন। এ পদে থাকাকালীন তার উদ্যোগে কুরআন শরিফের মূল আরবি থেকে বাংলায় তর্জমা প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ও তিনি আইয়ুব খানের বাঙালি বিরোধী কার্যক্রমের প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তান সরকারের বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন রেডিও টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধের ঘোষণা করলে তিনি এ সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানান।

আবুল হাশিম ইসলাম ধর্মের দার্শনিক দিকগুলি গভীরভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তার রচিত বইগুলো পাঠে এ সত্য পরিষ্কার বোঝা যায়। তার রচিত বইগুলো হচ্ছে, দ্যা ক্রিড অফ ইসলাম (The Creed of Islam)-১৯৫০, অ্যাজ আই সি ইট (As I See It)–১৯৬৫, ইনটিগ্রেশন অফ পাকিস্তান (Integration of Pakistan)-১৯৬৭, অ্যারাবিক মেড ইজি (Arabic Made Easy)–১৯৬৯, রব্বানীর দৃষ্টিতে-১৯৭০ এবং ইন রেট্রোস্পেকশন (In Retrospection)-১৯৭৪।

১৯৪০ সালে আবুল হাশিম দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় পড়ে যান। ১৯৫০ সালে তিনি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যান। এ অবস্থায়ই ১৯৭৪ সালের ৫ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।