ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি প্রসঙ্গ

নাজমুল হাসান

প্রকাশিত : মার্চ ২০, ২০২০

কয়েকদিন ধরে ‘ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি নেই’— এ রকম একটা হাদিসের কথা খুব জোরেসোরে প্রচারিত হচ্ছে। যেহেতু আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জানাচ্ছে যে, ব্যাধি সংক্রামক হতে পারে। ফলে কিছু মানুষের মনের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ তৈরি হচ্ছে যে, রাসুল (সা.) এমন কথা বলেছেন, যার কোনো ভিত্তি নেই! (নাউজুবিল্লাহ)।

মূল সমস্যা হচ্ছে, যারা এই হাদিস প্রচার করছে তাদের অনেকেই জানে না যে, এই হাদিসটি কোথায় আছে বা হাদিসে মূলত কী বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) একটি হাদিসে বলেছেন, ‘একজন ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে তা-ই বলে বেড়ায়।’ যে কোনো একজন মানুষের কথাকে আপনি যদি আউট অফ কনটেক্সট কৌট করেন, তাইলে সে ব্যাপারে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। হাদিস শাস্ত্র তো মূলত রাসুলের কথা ও কাজের বিবরণ। আপনি যদি কোনো একটা হাদিসের প্রেক্ষাপট না জানেন, ওই বিষয়ক অন্যান্য হাদিসগুলো না জানেন— শুধু মাঝখান থেকে একটা কথা শুনেই এটা কিভাবে সম্ভব যে, আপনি ওই হাদিসটা বুঝে যাবেন? একারণে কুরআন বোঝার জন্য যতটুকু কসরতের প্রয়োজন, হাদিস বোঝার জন্য তার চাইতে অনেক বেশি কসরতের প্রয়োজন। এজন্য কোনো একটা হাদিস পড়েই বা শুনেই কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো বা বিচলিত হওয়া ঠিক নয়। সুযোগ থাকলে চেষ্টা করা উচিত ওই বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেয়ার।

এবার আসি মূল কথায়। রাসুল (সা.) আসলে কী বলেছেন। যে হাদিসটিতে ‘সংক্রামক ব্যাধি বলতে কিছু নেই’ কথাটি রাসুল (সা.) বলেছেন, এই একই বিষয়ক হাদিস ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনাকারী থেকে ভিন্ন ভিন্ন টেক্সটে শুধুমাত্র সহিহ বুখারির ‘মেডিসিন অধ্যায়’য়ে অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হাদিস নম্বর ৫৭০৭, ৫৭১৭, ৫৭৫৩, ৫৭৫৬, ৫৭৫৭, ৫৭৭০, ৫৭৭২, ৫৭৭৩-৫৭৭৫ এবং ৫৭৭৬। এখানে বর্ণিত হাদিস নম্বরগুলোর প্রত্যেকটিতে ‘সংক্রামক ব্যধি নেই’ কথাটি আছে, কিন্তু কেউ যদি এই কথার পরের অংশ বা আগের অংশগুলো না পড়ে, তাইলে কিভাবে এই কথার মূল উদ্দেশ্য বুঝতে পারবে?

৫৭০৭ নম্বর হাদিসে উল্লেখ আছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, “রোগের কোনও সংক্রমণ নেই, কুলক্ষণ বলে কিছু নেই, পেঁচা অশুভের লক্ষণ নয়, সফর মাসের কোনও অশুভ নেই। এবং কুষ্ঠ রোগী থেকে সেভাবে দূরে থাকো, যেভাবে তুমি সিংহ থেকে দূরে থাকো।” এখানে খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে, রাসুল (সা.) কুষ্ঠ রোগী (Leper) থেকে দূরে থাকতে বললেন। এখন প্রশ্ন হলো, কেন? রোগের সংক্রামণ বলতে যদি কিছু না থাকে তাইলে রাসুল (সা.) কেন দূরে থাকতে বললেন? এবং প্রথমে ‘রোগের সংক্রামণ নেই’ বলতে রাসুল (সা.) আসলে কী বুঝিয়েছেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজবো। তার আগে আরো কয়েকটি হাদিস দেখে আসা জরুরি।

৫৭১৭ নং হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, “সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই। কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই। সফর মাসকেও অশুভ মনে করা যাবে না এবং পেঁচা সম্পর্কে যেসব কথা প্রচলিত রয়েছে, তাও অবান্তর।” তখন এক বেদুঈন বললো, “হে আল্লাহর রাসুল, আমার উটের পাল অনেক সময় মরুভূমির চারণভূমিতে থাকে। মনে হয় যেন নাদুস-নুদুস জংলি হরিণ। এরপর সেখানে কোনো একটি চর্মরোগে আক্রান্ত উট এসে আমার সুস্থ উটগুলোর সাথে থেকে এদেরকেও চর্মরোগী বানিয়ে দেয়।” তখন রাসুল (সা.) বললেন, “প্রথম উটটির রোগ তাহলে সৃষ্টি করলো কে?”

এখানে খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে, একটি উটের রোগ থেকে আরেকটি উট সংক্রামিত হতে পারে, এটি কিন্তু রাসুল (সা.) অস্বীকার করেননি। বরং তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, “প্রথম উটটির রোগ রোগ কে সৃষ্টি করলো?” এর দ্বারা স্পষ্ট হয়, রাসুল (সা.) মূলত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, রোগ মৌলিকভাবে আল্লাহর কাছ থেকে আসে। তারপর আল্লাহ চাইলে সেটি সংক্রামিত হতে পারে। তাইলে আবারও প্রশ্ন আসবে, ‘রোগের সংক্রামণ নেই’ বলতে রাসুল (সা.) আসলে কী বুঝিয়েছেন।

৫৭৭১ নম্বর হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, “রোগাক্রান্ত উটকে যেন সুস্থ উটের সাথে একত্রে পানি পানের জায়গায় না আনা হয়।” প্রশ্ন হচ্ছে, রাসুল (সা.) যদি মৌলিকভাবে রোগের কোনো সংক্রামণ নেই এটাই বুঝিয়ে থাকতেন, তাইলে অসুস্থ ও সুস্থ উটকে একসাথে পানি পানের জায়গায় নিয়ে আসতে নিষেধ করলেন কেন? সহিহ মুসলিমের একটি হাদিসে ‘সাকিফ’ গোত্রের এক কুষ্ঠ রোগীর কথা উল্লেখ আছে, যাকে বাইয়াত সম্পন্ন হবার পরে রাসুল (সা.) তার নিজ এলাকায় ফিরে যেতে বলেছিলেন। সুনান ইবনে মাজাহর একটি হাদিসে বর্ণিত, রাসুল (সা.) লেপরেসিতে আক্রান্ত ব্যক্তির দিকে তাকাতে নিষেধ করেছিলেন।

এর বাইরে অনেকগুলো বহুল প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ হাদিস রয়েছে, যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্লেগে আক্রান্ত এলাকায় যেতে ও সেখান থেকে বের হতে নিষেধ করেছেন। তাইলে উপরোক্ত হাদিসগুলো থেকে একথা খুবই স্পষ্ট যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) সংক্রামক ব্যাধির কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করেননি। তিনি সংক্রামক ব্যাধির কথা বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করেছেন এবং এক্ষেত্রে করণীয় কী, তাও উল্লেখ করেছেন।

তাহলে ‘সংক্রামক ব্যাধি নেই’ বলে রাসুল (সা.) যে কথাটি বলেছেন, তা দ্বারা কী উদ্দেশ্য? এই কথার উদ্দেশ্য বোঝা যাবে এই বিষয়টির পরে রাসুল (সা.) আরো যে দু-তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছেন, তার দিকে তাকালে। সেখানে রাসুল (সা.) পাখি দ্বারা শুভ বা অশুভ নির্ধারণ করা, সফর মাসকে অপয়া মনে করাকে নিন্দা করেছেন। তৎকালীন সময়ে লোকেরা অতিপ্রাকৃত কিছু শক্তিতে বিশ্বাস করত, যার প্রভাবে একজনের কাছ থেকে অন্যের কাছে রোগ সংক্রামিত হতো বলে তাদের বিশ্বাস ছিল। রাসুল (সা.) এখানে মূলত এই ‘অতিপ্রাকৃতে’র সংক্রামণ, পাখি দেখে শুভ-অশুভের অনুমান, নির্দিষ্ট দিন-মাসকে বিশেষ কিছু কাজের জন্য অশুভ মনে করার মতো কুসংস্কারের নিন্দা করেছেন এবং এ থেকে মুমিনদেরকে সতর্ক করেছেন এবং মানুষের চিন্তাকে এক আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন। সমস্ত ভালো-মন্দ, সুস্থতা-অসুস্থতা— দেয়া এবং এ থেকে শেফা দেয়ার মালিকও সেই আল্লাহ। তিনি যা ইচ্ছা করেন, তা-ই করেন। যেভাবে ইচ্ছা করেন, সেভাবেই করেন। মানুষ হিশাবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, দুনিয়াবি নিয়মে কল্যাণ ও আরোগ্যের অনুসন্ধানের সাথে সাথে একমাত্র তার কাছেই দু’আ অব্যাহত রাখা।