ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভি: আমার প্রথম গুরু

তুহিন খান

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৯, ২০১৯

‘এসো আরবি শিখি`র ক্লাসে প্রথম দিন হুজুরের সাথে আমাদের পরিচয়। এমনিতেই উনার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ছিল; `এসো আরবি শিখি`র লেখকের প্রিয় ছাত্র উনি, উপমহাদেশের বিখ্যাত ইসলামি চিন্তক আলি মিয়ার ছাত্র উনি, লেখালেখি করেন, একাধারে আধুনিক আরবিতে আর বাঙলা ভাষায় ওনার মত পারদর্শী লোকও তো হাতেগোনা, অন্তত আমাদের বিশ্বাস ছিল এমনই! ফলে, ওনার ভক্ত হইতে আমরা প্রস্তুতই ছিলাম। প্রথম দিন ক্লাশে ওনার কথা শুনলাম, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখলাম, পড়ানোর পদ্ধতি জানলাম। ভক্তি পূর্ণ হইলো তখন।

হুজুরের ছাত্র ছিলাম দীর্ঘ সময়। এই দীর্ঘ সময়ে হুজুরের কাছ থেকে কত বিচিত্র ফায়দা হাসিল করছি, বইলা তো বুঝানো যাবে না। আরবি ও বাঙলা ভাষা— এই দুয়ের প্রতি এক ধরনের মোহ তৈরি করছিলেন হুজুর আমাদের ভিতর। যেকোনো জিনিশের প্রতি আগ্রহ জাগানো আর মোহ তৈরি করা এক জিনিশ না। মোহ তৈরি করার জন্য খালি ওই বিষয়ে যোগ্যতা থাকলেই হয় না, আরো বেশি কিছু লাগে। রস লাগে, ওই জিনিশটা যে কত `সেক্সি`, তা বুঝানো লাগে। আরবি ভাষাটারে আমাদের কাছে `সেক্সি` বানাইছিলেন উনি। ওনার আরবি উচ্চারণ, আরবি থিকা বাঙলায় অনুবাদ, আরবি ভাষা নিয়া ওনার সমস্ত কাজকারবার আমাদের টানতো।

দীর্ঘ ছাত্রজীবনে হুজুরের কাছে আমি বেসিকালি আরবি ভাষা ও সাহিত্যই পড়ছি। `এসো আরবি শিখি`, যে বই আমাদের আরবি ভাষাজ্ঞানের ভিত্তি, যে বই বাঙলাদেশে আরবি ভাষাশিক্ষায় একটা রেভ্যুলুশনও বটে, সেই বই দিয়া শুরু। তারপরে আরো পড়ছি `কাসাসুন নাবিয়্যিন` চার খণ্ড, `মুখতারাত`, `মাকামাতে হারিরি`। কোরানের তরজমাও পড়ছি হুজুরের কাছে, সম্ভবত ১১-২০— এই দশ পারা। আরবি অলঙ্কারশাস্ত্রের বিখ্যাত কষা কিতাব `মুখতাসারুল মায়ানি` আমরা পড়ছি হুজুরের কাছে। বেফাকের এক্সামে আমি মুখতাসারে পাইছিলাম ৯০। এইটা পুরাপুরি হুজুরের অবদান; উনি এমনভাবে পড়াইছিলেন, এক মুহূর্তের জন্যেও এই কিতাবটা আমার কঠিন লাগে নাই।

হুজুরের সাথে ব্যক্তিগত স্মৃতি-টিতি তো ম্যালা। হুজুর আমারে পছন্দ করতেন, আমিও হুজুররে মন থেকে ভালবাসি। `এসো আরবি শিখি`র প্রত্যেকটা ক্লাস এখনও আমার স্মৃতিতে এতটাই জিন্দা, যেকোনো মাদ্রাসায় আমি এই বইয়ের দরস দিতে পারব। ওই সময় আলি তানতাবি`র একটা ছোট রেসালা অনুবাদ করছিলাম— আর রিযকু মাকসুমুন, লাকিন্নাল আমাল লাহু ওয়াজিবুন। হুজুররে দেখাইতাম মাঝেমধ্যে। তখনও হুজুর দ্বিধায় ছিলেন, আমারে শিষ্য হিশাবে নিবেন কিনা। আমার ছাত্রভাই ছিলেন শাহ এহতেশাম ফাহিম, আমাদের আহসান যাইফের চাচা। তো, হুজুর আমাদের দুইজনের লেখার তুলনা কইরা বলতেন, `মইন অনেক ফেনিয়ে লেখে, ফাহিমের লেখা খুব সুসংহত`। ফেনানোর অভ্যাস তো যায় নাই আমার এখনও, এই যে কতকিছু লেইখা ফেলতেছি!

আল কাওসারের পাঠাগার থিকা নিয়া ড. আহমদ আমিনের `দুহাল ইসলাম` পইড়া ফেললাম তখন। ওই বইয়ে মুতাযিলাদের চিন্তার একতরফা প্রশংসা করছেন ড. আমিন। তো, ব্যাপারটা আমার পছন্দ হইল না অত। দেখলাম, বইটা অনুবাদ করছেন হুজুরের ওস্তাদ, আমাদের `এসো আরবি শিখি`র লেখক আবু তাহের মেসবাহ। তো, আমি ভাবলাম, উনি এই বই অনুবাদ করছেন ক্যান? হুজুররে জিগেশ করলাম। হুজুর কইলেন, অনুবাদকের সাথে আসল লেখকের চিন্তার মিল তো জরুরি না। বইটা গুরুত্বপূর্ণ, ফলে এইটা বাঙলাভাষায় থাকাও গুরুত্বপূর্ণ; জ্ঞানচর্চার কালচার এইভাবেই তৈরি হয়। অনুবাদের ব্যাপারে এই ছিল আমার পয়লা সবক।

হুজুর আমারে একটা কলম দিছিলেন লেখার জন্য, হারাইয়া ফেলছি। উনি মুখতারাত পড়াইছিলেন আমাদের, আমি প্রায় সবগুলা দরসের নোট নিছিলাম। হুজুর একটা শব্দের অনেকগুলা অর্থ বলতেন, একটা বাক্য কতভাবে তরজমা করা যায়, সম্ভাব্য সবগুলা বিকল্প বলতেন, পরে একটারে প্রায়োরিটি দিতেন, শব্দের অরিজিন আর ভার্বের সাথে একেক ফ্রেজ বা প্রিপজিশন যুক্ত হইলে অর্থের কি বিভিন্নতা হয়— সবই বলতেন। তো এইগুলা আমি লেখতাম ক্লাশে।

বছর শেষে হুজুর বলছিলেন পুরাটা ফ্রেশ খাতায় তুইলা উনারে দিতে। আমার আবার ওই বছর এইটের এক্সাম। বাসায় আইসা আর এইটা করা হইল না। মাদ্রাসায় গেলাম এইটের এক্সাম দিয়া, দুই মাস পর। হুজুর খুব গোস্বা হইলেন। ক্লাশে বসতে দিলেন না এক সপ্তাহ। পরে বললেন, তুমি আমার কাছে চিঠি লেখবা। যদি চিঠি পছন্দ হয়, তাইলে বসতে দিমু। তো, ওই শুরু। আমি হুজুরের কাছে দীর্ঘ দীর্ঘ চিঠিপত্র লেখতাম। এরমধ্যে সবচাইতে বড়টা ছিল মেবি ৩২ পেজের। হুজুর এইসবের উত্তর দিতেন। আমার ওইসব চিঠির একমাত্র পাঠক ছিলেন মাগফুর ভাই। ওইগুলা এখন কই আছে, কে জানে!

হুজুর আমাদের অনেক বই সাজেস্ট করতেন। হুমায়ুন আজাদের `ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না` সাজেস্ট করছিলেন একবার, আমরা বাংলাবাজার গিয়া অনেকে একসাথে এই বই কিনছিলাম, মনে আছে।

হুজুরের বইপত্র আমাদের খুব পছন্দ ছিল। ওনার ওই সময়কার অলমোস্ট সব বই আমার কালেকশনে আছে। যদিও এখন, উনার ভাষাচিন্তা, সাহিত্যচিন্তা ইত্যাদির সাথে একটা ছেদ হইছে আমার। ভাষা নিয়া ওনারা ক্রিটিক্যালি চিন্তা করতে পারেন নাই; বাঙলাদেশের ডমিনেন্ট ভাষা ও সাহিত্যচিন্তারেই মূলত কপি করতে চাইছেন। `ইসলাম`ই ছিল সেক্যুলার সাহিত্যের বিরুদ্ধে ওনাদের ফাইট দেওয়ার একমাত্র অস্ত্র, কিন্তু বাঙলাভাষা নিয়া ওনাদের কোন ক্রিটিক্যাল বোঝাপড়া ছিল না— এমন মনে হইছে আমার পরে। ওনাদের লেখাপত্র মূলত ছিল গল্প; ইতিহাসরে গল্পের ছলে বলা, সবকিছুরে ফিকশন বানানো। কিন্তু, একটা শক্তিশালী ফিকশন তখনই হয়, যখন তার পিছনে একটা পোক্ত ক্রিটিক্যাল আইডিয়ার ভিত থাকে। সেই ভিতটা ওনাদের লেখালেখিতে, আমার মনে হইছে যে, মিসিং। মডার্নিজমের লগে ইন্টেলেকচুয়াল ফাইটটা ওনারা দিতে পারেন নাই। সেই জায়গাগুলা এখনও তো ফাঁকা। ফাঁকা ভরতে আমদানি হইছে `প্যারাডক্সিকাল সাজিদ`।

এসব সত্ত্বেও, হুজুরের সিরাতের বইগুলা, `গল্পে আঁকা ইতিহাস` সিরিজ, আলোর দিগন্তে হযরত ওমর— আমার খুবই প্রিয় বই। `গল্পে আঁকা ইতিহাস` ছিল কয়েকটা চটি বইয়ের একটা সিরিজ। বইগুলা ছিল রঙিন, পুরা বইয়ে ছবি আর ইলাস্ট্রেশন। বইগুলা ধরতেই আনন্দ লাগতো। এই বই মার্কেট আউট হওয়ার পরে, হুজুররে এত জ্বালাইছি, দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় সেই জ্বালাতনের কথা লেখতে হুজুর বাধ্য হইছেন। কারুর কাছে থাকলে দেখবেন। তো এই বইটা হুজুর নিজের প্রকাশনী, `কানন` থিকা করছিলেন। হুজুরের উন্নত প্রকাশনা রুচির লগে তখন আমাদের পরিচয় হইছিল।

হুজুরের লেখা পড়ি না অনেকদিন। মাঝে হুজুরের আরো যে দুই-তিনটা বই বের হইছে জানতামই না। হুজুরের `কানন` প্রকাশনী আবার নতুনভাবে চালু হইছে, তাও জানতাম না। পর্যাপ্ত ইনভেস্টমেন্ট আর প্রফেশনালিজম থাকলে, `কানন` ইসলামি প্রকাশনার জগতে বেশ নাম কামাইত, সন্দেহ নাই। `কানন` থেকেই হুজুরের এই নতুন বই দুইটা আসছে। বইগুলা হাতে নিলেই আরাম লাগে, চোখেও আরাম লাগে। নিয়া আসলাম বইগুলা।

হুজুরের কানে গেছে কেমনে কেমনে, আমি ইতালো কালভিনোর সাক্ষাৎকার অনুবাদ করছি, বই হইতেছে সেইটা। ইংরাজি থিকা অনুবাদ করতে পারি শুইনা, হুজুর খুবই খুশি নাকি হইছেন।

অনেক কথা বললাম হুজুররে নিয়া। আমার এই ওস্তাদের নাম ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভি। আমার আরবি আর বাঙলা ভাষাশিক্ষার প্রথম গুরু। আল্লাহ হুজুররে বাঁচাইয়া রাখুক, আরো অনেক অনেক দিন। হুজুরের মুখে আরেকবার ইমরাউল কায়েসের কবিতা শোনার আগে আমরা তো মরতেও ইভেন চাই না!