এ দোলা, এ দোলা... প্রিয় কবিতার বই

চয়ন খায়রুল হাবিব

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৯, ২০২০

লেখকের নিজস্ব বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে

 

গত একুশে বইমেলাতে বেরিয়েছিলো খায়রুল আলম চৌধুরীর অনুবাদে ইরাকি/এমেরিকান কবি দুনিয়া মিখাইলের ইরাকের রাত। প্রকাশের আগে তরতাজা অনুবাদগুলো একটা, দুটা করে খায়রুল আলম ওরফে আমাদের লিটু জুলেখা সিরাপ গ্রুপের সদস্যদের পাতে তুলে ধরছিল। ওই পাঠপর্বে আমিসহ আরো সুহৃদের মতামত যে লিটু গঠনমূলকভাবে বরন করে নিয়েছিল, তা বোঝা যায় বইটির যত্নবান চুড়ান্ত সম্পাদনায়।

একুশে মেলার আগদিয়ে যখন অনুবাদক এবং সুহৃদেরা বইটির কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছিল, তখন আমাদের চোখে এলো, বেহুলা বাংলা নামের একটি প্রকাশনি হুবহু একই শিরোনামে একই কবির অনুবাদ মেলাতে প্রকাশের ঘোষনা দিয়ে যাচ্ছে। আমি তখন ঢাকাতে, লিটুর সাথে যোগাযোগ হচ্ছিল দিনেরাতে কয়েক বার। লিটুর পাশাপাশি আমার জুলেখা ট্রিলজিও বেরুচ্ছিলো জাগৃতি প্রকাশনি থেকে।

লিটু থাকে কমলাপুরের কাছাকাছি, অফিস গুলশানে। আমি উঠেছি বনানিতে। জাগৃতির দফতর এলিফেন্ট রোডে। লিটুর নিজস্ব গাড়ি থাকবার পরও ঢাকাই ট্রাফ্রিক হুজ্জতিতে এই এপার ওপার যোগাযোগ প্রায় পুলসেরাত পার হবার সামিল।

ছাপাছাপির জুতা সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ সারছিলো বিল্লাল, আর তদারকিতে জাগৃতির কর্নধার রাজিয়া জলি। বেহুলা বাংলার ঘোষনা আমরা খুব সিরিয়াসলি নিলাম। যদিও ঢাকাই প্রকাশনির পুরোটাই দাড়িয়ে আছে কপিরাইট চোট্টামানি ও রয়্যালটি নাফরমানির ওপর, তা জেনেবুঝে লিটু, জলি, আমি আমাদের যোগাযোগে পেশাদারিত্ব পুরোপুরি বজায় রেখে, মেইল চালাচালিতে লিটু সিনে নিয়ে এলো দুনিয়া মিখাইলকে।

অনুবাদ উপলক্ষে দুনিয়া ও লিটুর কাব্যিক দহরম, মহরম আগে থেকেই চলে আসছিল। আনুষ্ঠানিক অনুমতি নিয়েই এ-প্রকাশনায় হাত দেয়া হয়েছিল। অপর প্রকাশনির ঘোষনাতে সচকিত হয়ে আমরা মেইল চালাচালিগুলোকে নিয়ে এলাম আইনগত কাঠামোর ভেতর। বেশ কিছু হুশিয়ারিমূলক চিঠি তৈরি করা হলো বাংলা একাডেমির মেলা অধিকর্তাদের কাছে পৌছে দেবার জন্য, আদালতের রুলিং এর জন্যেও প্রস্তুতি নেয়া হলো।

এর ভেতর আমার নিজের আট বছর ধরে লেখা ট্রিলজির হার্ড কপি, লিটুর ফাইনাল প্রুফ কপি ইত্যাদি নিয়ে বিল্লাল আক্ষরিক অর্থে উধাও! লিটু আর আমি আশির দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবলভাবে মিছিলবাজির ধাওয়া, পালটা ধাওয়া করেছি, বিকাল বেলায় প্রেম সেরে, বিবিধ শঙ্কায় দুলে বস্তিতে মাস্তি সেরে মাথাভর্তি কবিতা নিয়ে ভোরবেলা ফিরেছি যার যার ডেরায়। ফিরতে পেরেছি। বিল্লালের নিখোজ সংবাদে মনোপর্দায় ভেসে গেল ক্রস ফায়ার, বন্দুক যুদ্ধ, গুম খুন, জঙ্গিবাদ ইত্যকার সর্বনাশা চিত্রবিরুপময়তা।

বই প্রকাশের উত্তেজনায় যোগ হলো অপ্রকাশিত বিষাদ। ভালোয় ভালো বিল্লাল ফিরে এলো, বেহুলা বাংলাও আর তেড়িবেড়ি করলো না। পর্দার অন্তরালের নাটকিয়তা পেরিয়ে ইরাকের রাত দেখতে পেলো বাশের বাশি বাজানো, গালে কপালে পতাকা আকা, টেরাকোটার হাড়িকুড়ি সাজানো, গোস্তো, পরোটা, সিঙ্গাড়া, উবার, পাঠাও, রুগ্ন ঘোড়ার ক্ষুরে ঝিমানো, রিক্সার হুড ঢাকা বেলি, চামেলির ইশারা সমেত ধোয়াশা ধুলায় রহস্যঘন ঢাকাই পুর্নিমাকে!

দুনিয়ার শৈলি নিয়ে বলা যাক। যারা আরবি দুনিয়ার কাহলিল জিব্রানের বা এডোনিসের দির্ঘ কবিতার সাথে পরিচিত তারা দুনিয়ার কবিতাতে সেই পরিব্যাপ্তি না পেলেও ব্যক্তিক অভিজ্ঞতালব্ধ জৈবিক রসায়নের সাথে সামাজিক আয়নার ভাঙ্গা কাচগুলো দেখতে পাবেন। মাহমুদ দারউইশের মতো এই ভাঙা কাচগুলোকে নিজের আত্মার কাটাছেড়ায় ব্যবহার না করে বরং সেগুলোকে জুড়ে একটা কোলাজে আনার প্রবনতা দেখা যাবে দুনিয়ার কবিতায়।

ছোট্ট একটি কবিতার পাশে দেখা যাবে ছোট্ট একটা পেন্সিল আকা ছবি। অধুনা তুমুল পরিচিতি পাওয়া এবং বহুল বিক্রিত রুপি কাউরের কবিতা প্রয়াসেও এ-প্রবনতা লক্ষনিয়। রুপির সাথে দুনিয়ার পার্থক্যটা হলো, দুনিয়াকে যে- ট্রমার ভেতর দিয়ে আসতে হয়েছে, রুপিকে তার মুখোমুখি হতে হয় নাই। কিন্তু সে-ট্রমা দুনিয়ার আত্মসংহতিকে ভাংতে পারে নাই, তাকে নৈর্ব্যাক্তিক ও চিৎকৃত স্লোগানে একমুখি করে দেয় নাই। ওর শব্দের কোলাজ ও পেন্সিল স্কেচ আত্মমগ্ন হবার পরেও যোগাযোগ প্রবন, এগুলো কথা বলে চেতনা ও অবচেতনার কয়েকটি স্তরে।

কবিতাগুলো সহজ, কিন্তু এগুলোর পেছনে চিন্তা কাজ করে এবং ছোট পরিসরে দুনিয়া সে-চিন্তাকে পুর্নতা দিতে পারে। রুপি কাউরের মতো দুনিয়াও চন্দ্রাবতি, মিরা বাই, শাপ্য, সিলভিয়া প্লাথ, আন সেক্সটন, মল্লিকা সেনগুপ্ত, তসলিমা নাসরিনদের সাথে ব্যক্তিক স্বিকারোক্তি ও ভবিষ্যতবোধক উন্মোচনের পরম্পরায় সম্পর্কিত। কবিতাগুলো সুখবোধ্য এবং অনেকগুলো নান্দনিক সম্ভাবনার উস্কানি দেয়। দুনিয়ার শৈলিতে অনুবর্তি থেকে লিটু ওর অনুবাদের পাশাপাশি স্কেচগুলোর মুদ্রনেও যত্নবান থেকেছে।

ইরাকের রাত সংগ্রহে রাখবার মতো, বারবার চাখবার মতো একটি বই। বইমেলার সময়কার আঠালো, মুদ্রারাক্ষসিয়  চাপাচাপির ভেতর লিটুর তদারকির কল্যানে এ-প্রকাশনাটি জাগৃতি ভালো করেছে। আমার জুলেখা ট্রিলজির দ্বিতিয় পর্বে যে লেখিকা-জুলেখা পাশবিক জেরার মুখোমুখি, পরিবেশভেদে সেই কি ইরাকের ভয়াবহ আতঙ্কদায়ক পটভুমি থেকে পলাতক দুনিয়া মিখাইল? আমরা সব লেখক মিলে কি ইতিহাসভর একটি মহাকাব্যই লিখে যাই না? সব পাঠক মিলে কি ইতিহাসের বিভিন্ন মোড়ে আমরা একটি মাত্র মহাকাব্যকে বিভিন্ন দোটানায় বিচিত্রভাবে দোলাই না?

এ দোলা, এ দোলা... ইরাকের দোলা, বাংলার দোলা, যাপনের দোলা, মানুষের দোলা, কবিতার দোলা!

১৮.১.২০২০
ব্রিটানি, ফ্রান্স