এই দুর্যোগ যাদের কোমল করে না তারা কীসের মানুষ!

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৭, ২০২০

আলিমদের মধ্যে রেষারেষি হয়তো সকলের জন্যে ‘বরকত’। কারণ এতে সবাই নিজে নিজে কষ্ট করে ইসলাম শেখার চেষ্টা করবে। আলিম নির্ভরতা কমবে মানুষের। এই কমার পেছনে হয়তো দায়ী থাকবে কোনও কোনও আলিম। দায়ী থাকবে জনগণও। কারণ কেন তারা আলিম চেনার মতো জ্ঞানটুকু অর্জন করলো না!

আলিমদের রেষারেষিতে নিজে নিজে বই পড়ে ইসলাম শেখার প্রবণতা বাড়বে। কারণ কোন আলিমের কাছে সে যাবে? যে আলিমের কাছেই যান, অন্য কোনো-না-কোনো আলিমের কাছে সে তো গোমরাহ, নানা ট্যাগে ট্যাগিত। দেশীয় আলিমরা গ্রহণযোগ্যতা হারাবে, ভিনদেশি আলিমদের লেখা, বয়ান আর ফতোয়ার দ্বারস্থ হবে মানুষ।

আলিমদের মধ্যকার রেষারেষি এ কালে প্ররোচিত করবে সাধারণ মানুষকে নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিতে। বে-আলিম, ইসলাম সম্পর্কে যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জ্ঞান অর্জন করেনি, সে তর্ক করবে আলিমের সাথে। এছাড়া নিজে নিজে এক আধটা তাফসির পড়ে, কিছু হাদিস পড়ে সাধারণেরাই নিজেদের মতো করে চলা শুরু করবে, এবং ফতোয়াও দেবে টুকটাক, অন্যের জন্য না হলেও, নিজের জন্যে। তবে তা অচিরেই অপর-মুখীও হবে। সামনে এটাই ঘটবে। স্কুলের ইসলাম শিক্ষা, টুকটাক ইউটিউব আর দুই-চারটা ইসলামি বই পাঠ হবে আমাদের ইসলাম!

সবাই হকের একমাত্র দাবিদার হয়ে বসে আছে। অনেকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অহমে বন্দি। অনেকে পারিবারিক ইসলামি ঘরানায় আবদ্ধ, কেউ-বা যে প্রতিষ্ঠানে পড়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানকেই হকের একক ও একমাত্র চর্চাকারী ভেবে বসে আছে। কেউ হয়তো-বা পীরকেই একমাত্র হকের ধ্বজাধারী মানছে। যার কাছে যা আছে তা-ই নিয়ে সন্তুষ্ট সবাই। কিছু আয়াতকে আমরা শুধু কুফফারের জন্যে নির্দিষ্ট ভাবি। যেমন, ‘যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তার আনুগত্য করো তখন তারা বলে, আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে যে রীতির ওপর পেয়েছি তার আনুগত্য করবো।’ (সুরা লোকমান)। নিজ ঘরানাকে একমাত্র হকপন্থী যারা বলে, তাদেরকেও এই আয়াতের বিষয়বস্তু কি ভাবা যায় না?

মতভিন্নতা স্বাভাবিক। কিন্তু ক্ষমতার পিপাসা, মাসলাকগত আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার কারণে যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধিতার জন্ম, তা শেষমেষ দ্বীনেরই ক্ষতি করে, দু’একজন ব্যক্তির লাভ হলেও। দ্বীনকে ছাপিয়ে যখন বিদ্বেষ ও বিবাদ বড় হয়ে ওঠে, তখন দ্বীন আর দ্বীন থাকে না, তা হয় গোষ্ঠীপ্রেম বা ক্ষমতাপূজা বা আত্মপ্রেম। কোনও সর্বজন গ্রহণযোগ্য আলিমের উপস্থিতি বোধহয় সম্ভব নয়, হয়তো দরকারও নেই। কিছুটা ইসলামি জ্ঞান আর আকল ব্যবহার করেই বোধহয় চলতে হবে মানুষকে, গ্রহণযোগ্য দিকনির্দেশনার অভাবে।

কোনও আলিম জনপ্রিয় হয়ে উঠলে চারদিক থেকে শত্রুতার বাণ ধেয়ে আসে তার দিকে। এই বাণ আসে অপরাপর আলিমদের থেকেই। এই বাণ নিক্ষেপ কোনও ইলমি আলোচনা দিয়ে হয় না, হয় ঈর্ষা দিয়ে, পরশ্রীকাতরতা দিয়ে, যা যেকোনো সাধারণ অ-আলিমের চোখেই পড়বে। এই বাণ চলে দ্বীনের নামে, মাসলাকের নামে। আফসোস এখানেই। অথচ তারা জানেই না, এতে সাধারণের ও অনাগত তালেবে ইলমের চোখে তারা কত নিচে নামতে থাকে, নিচে নামতে থাকে!

তবুও মনে মনে চাই, এমন আলিম ও এমন আলিমসম্প্রদায় যাকে বা যাদেরকে দিলের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে পারবো, উম্মাহর জন্যে দরদ উথলে উঠবে যাদের হৃদয় থেকে, শুধু দ্বীনি নয়, মানুষের দুনিয়াবি প্রয়োজনেও যারা তাদের সামর্থের পরিচয় দেবে, যাদের ইলমের উপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারবো। কিছু কলহপ্রেমী, বিভক্তিপিয়াসী তরুণ আছে যারা ইসলাম বিষয়ে পোস্টেও বিভক্তি ছড়ায়, করোনার দুর্বিপাকেও তারা অপর মুমিনভাইকে শত্রু বানাতে কুণ্ঠিত হয়না। বরঞ্চ মনে করে, তারা বিশাল দ্বীনি খেদমত করছে! এ

এই দুর্যোগ যাদের কোমল করে না তারা কীসের মানুষ! কীসের মুমিন! মুমিনরা তো নিজেদের প্রতি রহমশীল, আর কুফফারের প্রতি কঠোর। এরা তো উল্টো প্রায়! অবশ্য টানেলের শেষে আলোর রেখাও আছে। অসম্ভব দূরদর্শী প্রজ্ঞাবান কিছু তরুণ-আলেম দেখি, যাদের দ্বীনি অন্তর্দৃষ্টি আর দুনিয়াবি জ্ঞান আমাকে মুগ্ধ করে। তাদেরকেই দিশারি ভাবি, তাদের জন্যে দোয়া ও ভালোবাসা।

ব্যক্তিগতভাবে, আমি আলেমদের কাছ থেকেই দ্বীন শেখার পক্ষে। তাঁদের কাছ থেকেই শিখি, ও শিখতেও চাই। তাঁদের শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। আমার কাছের জনেরা জানেন। এই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় কোন কারণে ফাটল ধরলে নিজেকেই ধিক্কার দেই, ভাবি আমিই ভুল, কিন্তু সবসময় আঙুলটা নিজের দিকে রাখতে পারি না, তখন দুঃখ আরো বাড়ে , অশ্রু ঝরে। দোয়া করা ছাড়া অসহায়ের আর কিছু নেই বোধহয়!

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক