একজন সুচিত্রা সেন ও আমার বির্তক প্রতিযোগিতা

লতিফ জোয়ার্দার

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৪, ২০১৯

আজ থেকে অনেক অনেক দিন আগের কথা। কেলেন্ডারের পাতায় লেখা ছিল ১৯৮৯ সাল। হয়তো সেই সময়ের কেলেন্ডার এখন আর কারো ঘরে নেই। পঞ্জিকার যুগ শেষ হয়ে গেছে। তখন এখনকার মতো রাস্তাঘাট এত উন্নত ছিল না। বাজারঘাট এত উন্নত ছিল না। বেশির ভাগ গ্রামে মাটির ঘরের প্রচলন ছিল। আমাদের বাড়িতেও দুটি মাটির ঘর ছিল। ঘরগুলো দেখতে বড়ই অদ্ভুত। অনেকটা ভ্রমর বাসা বাঁধলে যেমন লাগে। গ্রামময় মাটির ঘরের গুণকীর্তন ছিল সবার মুখে মুখে। তখন তো আর সবখানে এসির প্রচলন ছিলো না। আমিও এসি শব্দের সাথে একেবারে অপরিচিত ছিলাম। মাটির ঘরে থাকলে গরমের দিনেও বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব লাগতো। আমাদের দুটো মাটির ঘরে তিনটা রুম। তার একটাতে থাকতাম আমি। তবে গ্রামের চেয়ে শহরেই বেশির ভাগ সময় থাকি তখন। তবে শহরে থাকলে কী হবে, গ্রামের বনফুল, পাখি, মরা নদীর কথা কিছুতেই ভুলতে পারতাম না। বুকে বাজতো গ্রামের মানুষের কথা।

সে সময় এডওয়ার্ড কলেজে ডিগ্রিতে পড়ি আমি। বাউণ্ডুলের মতো শহরময় ঘুরে বেড়াই। মাঝে মাঝে একজন সুচিত্রা সেনের সন্ধান করি। টানা টানা চোখের উন্নত নাসিকায় সে যেন কোনো এক হৃদয়দেবী। তবে লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কলেজে ব্যাপক পরিচিত ছিলাম আমি। কলেজের সব নেতা-কর্মীরা ভালোবাসতো আমায়। সাধুপাড়ায় যে বাসায় থাকতাম সেখানে ছাত্রনেতাদের আনাগোনা ছিলো সবসময়। তবে আমি কোনো ছাত্র রাজনীতি করিনি কখনো। প্রগতিশীল দলের সর্মথক ছিলাম। দুই একবার রাজপথে মিছিলও করেছি। সেই মিছিলে যাওয়া ছিল নিজের ইচ্ছেতে নয়। বন্ধুদের চাপে পড়ে মিছিলের স্লোগানের সাথে তাল মিলিয়েছি। এরশাদ বিরোধী আন্দলনে নিজেকে উপস্থিত করেছি সব সময়। স্বৈরাচার শব্দটা তখন প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর মুখে মুখে। তবে সব কিছুর পরও একটা ঘোরের ভিতরে থাকতাম আমি। আমার বারবার মনে হতো, সেই কবে একদিন একটা মনখারাপের চারাগাছ লাগিয়ে ছিলাম। তা বুকের ভিতর দিনে দিনে বড় হতে ছিল। ঠিক যেন আমারই মতো।

আমার যেমন বয়স বাড়ছে। আমার যেমন উচ্চতা বাড়ছে। ঠিক তেমনি দিনে দিনেই মনখারাপের পরিমান বাড়তে ছিল। প্রতিটি সকাল ছিল এক একটা মন খারাপের সকাল। প্রতিটি বিকেল ছিলো এক একটি মন খারাপের বিকেল। তবে সবকিছুর পরও, আমি রাতদিন বন্ধু আড্ডায় ব্যস্ত ছিলাম তখন। একজন কবিতাকর্মী হিসেবে এই শহরের সবাই আমাকে চিনতো। স্যারদের সাথে ছিল সু-নিবিড় সম্পর্ক। সবাই আমাকে ভালোও বাসতো। ইংরেজির নজরুল ইসলাম স্যার আর বাংলার মনোয়ার হোসেন জাহেদীর স্যারের বাসায় যেতাম প্রাইভেট পড়ার জন্য। পড়া শেষে জুবলি ট্যাংকির পুকুর পাড়ে ফারুক, পলাশ, শিমুল, মিঠু, সুলতানদের সাথে আড্ডা হতো। কিন্তু দিনশেষে জেলাপাড়ায় একবার ঢুঁ না মারলে আমার পেটের ভাত হজম হতো না। কী যেন এক তাড়না ছিল আমার! একজন সুচিত্রা সেনের অপেক্ষা ছিল আমার। বাস্তবতা হলো, আমার আর সুচিত্রা সেনের গল্পটা অনেকটা এমনই। যেমন করে প্রতিদিন আমি কলেজের ইংরেজি বিভাগের বারান্দায় বসে থাকতাম। একবার মাত্র সুচিত্রাকে দেখবো বলো।

একটা সাদা কারে করে সুচিত্রা এসে নামতো। সাদা পোষাকে কালো চশমা ঢাকা তার দুই চোখ। শাফি নামে আমার এক বন্ধু ছিল। সব সময় আমার সাথেই থাকতো। তাকে দেখলেই শাফি বলতো, ওই দ্যাখ তোর সুচিত্রা এলো। সুচিত্রা নামটা আমারই দেয়া। তার প্রকৃত নাম আমার তখনো জানা ছিল না।

সেবার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে টিভি বির্তক প্রতিযোগিতায় চান্স পেলাম আমি। কলেজের হলরুমে বাছাই প্রতিযোগিতায় আবার দেখা হলো সুচিত্রা সেনের সাথে। সে ছিল আমাদের বিপক্ষ দলের প্রতিযোগী। বেশ বলতে পারে মেয়েটি। বলার ঢংও বেশ মুগ্ধকর। যুক্তি খণ্ডনেও বেশ পারদর্শী। সেদিন আমি একভাবে চেয়েছিলাম তার দিকে। বারবার মনে হচ্ছিল, একবার চোখের পলক পড়লেই সে হয়তো হারিয়ে যাবে। দশজন প্রতিযোগীর মধ্যে সে হলো তৃতীয়। বাবন প্রথম আর আমি দ্বিতীয়। তার এই বির্তক প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়াতে আমি তারচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলাম। আর সেদিন থেকে মনে মনে একটা স্বপ্ন বুনতে থাকলাম। এই বুঝি তার সাথে কথা বলার সুযোগ হলো। এই বুঝি তার সাথে আড্ডা দেবার সুযোগ হলো আমার। একসাথে ঢাকাতে যাওয়ার সুযোগ হলো আমার। সেদিনই প্রথম তার প্রকৃত নাম জানলাম। দীল আফরোজ কেয়া। সে দিনই প্রথম তার সাথে সামান্য একটু কথা হলো প্রতিযোগিতা শেষে।

তার কয়েকদিন পর রোজার ছুটিতে কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। তার সাথে দেখা হবার সব সম্ভাবনা হারিয়ে বিষণ্ণ মনে গ্রামের বাড়ি ফিরে এলাম আমি। অপেক্ষা রোজা কবে শেষ হবে। অপেক্ষা ছুটি শেষে আবার কবে আমাদের কলেজ খুলবে। আবার সুচিত্রা সেনের সাথে দেখা হবে আমার, কথা হবে। আমরা একসাথে বির্তক প্রতিযোগিতায় জয়ী হবার জন্য আড্ডা দেব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কিভাবে যেন আমার সব ভাবনাগুলোর মৃত্যু হলো। আর দেখা হলো না সুচিত্রা সেনের সাথে। আর কথা হলো না সুচিত্রা সেনের সাথে। আমারও আর বিটিভির বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করা হলো না। কারণ আমি গ্রামের ছেলে। সরাসরি কোনো রাজনীতি করি না। এইসব নানা প্রতিবন্ধকতায় ফিরে আসতে হলো আমায়।

রোজার ঈদের পরের দিন ছাত্রনেতা সাইফুল আলম সাবু এলো আমাদের বাড়িতে। তার জন্য বাড়িতে রান্নার আয়োজন হলো। খাবার খেতে খেতে সে আমায় বললো, ইংরেজি বিভাগের প্রধান সলেমান স্যার তোমাকে দেখা করতে বলেছে। এখনই একবার আমার সাথে যেতে হবে তোমায়। স্যার তোমার জন্যে কলেজে অপেক্ষা করছে। কোনো কিছু চিন্তা না করেই তার সাথে কলেজে গেলাম আমি। গিয়ে তো আমি অবাক। ছুটির দিন অথচ স্যারের অফিস খোলা। স্যার একটু গম্ভীর ভাবে তার চেয়ারে বসে আছেন। আমাকে দেখে তার মুখে যেন আলোর জ্যোতি ফুটে উঠলো। স্যারের অফিসে আমি আর সাবু ভাই। আশপাশে কোনোখানে আর কেউ নেই। স্যার বললো, দেখো লতিফ, এই কাগজটাতে একটু সিগনাচার করতে হবে তোমায়? আমি তখন স্যারে মুখে দিকে তাকিয়ে আছি।

ওখানে কি লেখা আছে স্যার।
ওখানে লেখা আছে তুমি বড্ড অসুস্থ। কিছুতেই এই বির্তক প্রতিযোগিতায় তোমার অংশ গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তোমার পরিবর্তে সাবু বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করবে।
বলেন কী স্যার! সাবু ভাই যাবে আমার পরিবর্তে? আমি একবার মাত্র সাবু ভাইয়ের দিকে তাকালাম। দেখি স্যারের সামনেই সাবু ভাই আমার তলপেটে চাকু ধরে আছে!