কতটা রাত্রি জেগেছ যে জ্ঞানার্থী হবে!

জগলুর আসাদ

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৮, ২০১৯

আমার ভেতরে যা নাই অন্যের ভেতরে তা দেখলে ভালো লাগে। বিহ্বল হই। যেমন, আমি ফিকশন পাঠে তেমন স্বচ্ছন্দ ছিলাম না কখনো। যদি কেউ গল্প-উপন্যাসের খুব অনুরক্ত পাঠক হয়, আমার ভালো লাগে। বহু বহু ফিকশন পাঠ করা লোকজন আমার পছন্দের। দরকার বিচিত্র ধরনের ফিকশন পাঠ। দেশি, বিদেশি, হালকা, গভীর, সহজ-জটিল।

বিচিত্র `বাস্তব`-এর সাক্ষাৎ ও অনুভবে ফিকশনের জুড়ি নেই। জীবনের বহুকৌণিক অবলোকন নভেলে যতটা হয়, অন্য মাধ্যমে ততটা নয়। নভেল সাহিত্যের সব মাধ্যমের নির্যাসই ধারণ করে প্রায়। সাহিত্যের অন্য মাধ্যমও কোনও না কোনও ভাবে `উপন্যাসায়িত`। মনে পড়ে, যখন নবম কিম্বা দশম শ্রেণিতে পড়ি, একটি দৃশ্যকে মনে হয়েছিল অভূতপূর্ব। এক মেয়ে বুঁদ হয়ে পড়ছিল। কোনও দিকে খেয়াল নেই। বারান্দার পিঁড়িতে বসে দীর্ঘ-ঘন চুল এলিয়ে দিয়ে অপরাহ্নের মৃদু আলোয় পড়ছিল সে। সুনীলের ‘প্রথম আলো’। ওই মগ্ন পাঠের কথা এখনো ভুলিনি।

আমার শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি ফিকশন পড়ুক, বলতে ইচ্ছে হয়। কে পড়বে, এই প্রশ্নের উত্তরে নীরবতাই কাঙ্ক্ষিত বটে। তবু বলি, বাংলা নভেলের পাশাপাশি ইংরেজি নভেল পড়ার অভ্যাস যদি করা হয়, তবে করতলে ভিড় করবে কত যে দেশ-মহাদেশ! মাসে একটি `ভালো` উপন্যাস পাঠ কাউকে দিতে পারে জীবনে মোহনীয় কিছু মুহূর্ত ও সঙ্গ, দৃষ্টির প্রসার ও উপলব্ধির কিয়ৎ উন্মীলন, একটু সন্তুষ্টির আত্মগত বোধও। সকলে তো নন-ফিকশন পড়ে না, পড়বে না।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রথম বর্ষেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নেয়ামত ইমাম পরামর্শ দিয়েছিলেন এক ডাউস বই পড়ার। ফ্রেড্রিক জেমসনের The Political Unconscious. আমি আর বন্ধু রায়হান বেশ কসরত করে বইটি পড়বার চেষ্টা করেছিলাম, আমাদের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে যেয়ে। তিনি সেই ১৯৯৯ সালেই আমাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, মার্কেজের বইগুলো পড়ে রাখতে। কারণ হিশেবে বলেছিলন, পরে অনেক কিছু পড়তে হবে, এখনি এসব পড়ে নাও, পাঠ্য বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে, অবসরে। আমাদের শিক্ষক কবি মোহাম্মদ রফিক স্যার, ১৫-২০টি মাস্ট-রিড বইয়ের নাম মুখে মুখে বলেছিলেন, আমরা লিখে নিয়েছিলাম। মনে পড়ে, আবু তাহের মজুমদার স্যার সারা বছর পড়বার জন্য ‘পাঠ্যবহির্ভূত’ বইয়ের একটা ছাপানো তালিকা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

আমার শিক্ষার্থীদের প্রতি আমারও পরামর্শও তা-ই, ‘পড়ে নাও’। আরেকটি জরুরি কথা, পাঠ্য বই না পড়াকে আমরা যেন পাণ্ডিত্য মনে না করি, ইন্টেলেকচুয়ালিটি না ভাবি। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এটা আখেরে কত ক্ষতিকর!

আমার প্রথম পোস্টিং ছিল সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে। উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে আমাদের এক শিক্ষার্থী ছিল। নাম পারমিতা। তো, কলেজের ইংরেজি প্রথম বা দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষা শেষ হলে পারমিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, পরীক্ষা কেমন হয়েছে? ও বলে ‘খুবই খারাপ হইছে।’ বললাম, ‘কেন?’। ও উত্তর দিল, ‘একটা ফিল-ইন-দ্য গ্যাপ মানে ভুল হইছে মনে হয়।’ এক মার্কসের একটা আইটেম ভুল হওয়াকেই সে বলছে, ‘পরীক্ষা খুব খারাপ হইছে।’ ওই পরীক্ষায় সে ৯০ বা ৯১ পেয়েছিল। এখন খুব সম্ভবত সে ডাক্তার।

যাই হোক, মূল কথা যেটা বলতে চাই সেটা হচ্ছে, সিরিয়াসনেস ও লেখাপড়াকে গুরুত্ব দেয়া। প্রথম থেকেই যে লেখাপড়াকে গুরুত্ব দেয়, সে জীবনের অন্যান্য কিছুকেও গুরুত্ব দেবে বলে আশা করা যায়। একটা সময় ছিল, একাডেমিক রেজাল্টকে গুরুত্ব দিতাম না। এটা ভুল ছিল। জানা ও ভালো ফল করা, দুটোকেই গুরুত্ব দিতে হবে। আমি চাই, আমার শিক্ষার্থী ও সন্তানেরা লেখাপড়ায় ছোট-ছোট ভুলগুলোকেও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করুক, `নির্ভুল` শিখে ভালো নম্বর পাক। পড়াশুনাকে গ্রহণ করুক সাধনার মতো করে। কতটা রাত্রি জেগেছ যে জ্ঞানার্থী হবে!

বাউণ্ডুলেপনা তোয়াক্কা না-করাকে, ক্লাস না করা, টিউটোরিয়াল বা পরীক্ষা না দেয়াকে, শিক্ষক আর কি জানে এমন হামবড়া ভাবকে এখনো যারা ইন্টেলেকচুয়ালিটি ভাবে, তাদেরকে সতর্ক করছি। আক্ষেপ করতে হবে সোনামনিরা। বেকনের পড়ামর্শ মনে করিয়ে দিতে চাই, যা পড়বে তা নিজের ভাষায় লিখবে ও অপর বন্ধুর সাথে আলোচনা করবে। তবেই, বেকনের মতে, পাঠে আসবে পরিপূর্ণতা ও যথার্থতা। আর দরকার সিস্টেমেটিকভাবে ভাবার অনুশীলন।

যতই অনিচ্ছা জাগুক, পাঠ্যবই পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়তি। তবে পাঠ্যবিষয় বুঝতে সহায়ক হয়, এমন বাড়তি পাঠ হয়তো পাঠ্যপুস্তকের আপাত কর্কশতাকে দূর করে দিয়ে শিক্ষার্থীকে যোগাবে জ্ঞানের আনন্দও, যার মূল্য অপরিসীম। আমার সন্তানেরা কিছুটা নিরানন্দ ও ক্লেশকর হলেও বর্তমানকে এমনভাবে গড়ে তুলুক, যাতে ভবিষ্যতে দীর্ঘাশ্বাস ফেলে বলতে না হয়, ‘শুধু গাফলতে, শুধু খেয়ালের ভুলে, দরিয়া অথৈ ভ্রান্তি নিয়াছি তুলে।’

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক