করোনা এবং বাঙালির রসবোধ

শিমুল বাশার

প্রকাশিত : মার্চ ২৮, ২০২০

গতরাতে অফিসের সব কাজ যখন গুছিয়ে এনেছি ঠিক তখন খবর পেলাম, বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানা উল্লাহ মিয়া মারা গেছেন। আমার এক কলিগ সাথে সাথে বলে উঠলেন, বেগম জিয়াতো ছাড়া পেয়ে গেছেন, আইনজীবী দিয়ে আর কি হবে?

নির্মম রসিকতার একটা টাটকা উদাহরণ দিলাম। শবরী কলার মতো আঙুল ঘুরিয়ে আস্ত মুরগির পেট কেটে নুডলস ভরে দিলেন কেকা ফেরদৌসী। ওদিকে মুরগি চিৎকার দিয়ে উঠল, আল্লাহ তোমার কাছে বিচার দিলাম…

বাঙালির রসবোধ নিয়ে এমন হাজারো উদাহরণ দেয়া যায়। তবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যেন প্রতিযোগিতা চলে, কে কত রসিক তার প্রমাণ দেয়ার জন্য। একটা পেইজও আছে, হিউমারানি। যারা যত বেশি হিউমারাস ভার্চুয়াল লাইফে তারা তত বেশি জনপ্রিয়। বাস্তব জীবনেও তাদের সঙ্গ খুব আনন্দদায়ক, এতে আমার কোনোই সন্দেহ নাই।

কিন্তু ঢাকা শহরের প্রায় দুই কোটি মানুষ যখন নিতান্তই গৃহবন্দি জীবন কাটাচ্ছে করোনা আতঙ্কে, তখন কখনো কখনো এসব রসিকতা নেয়া কঠিন হয়ে যায়। বাসায় আজ বুয়া আসেনি। স্বামী যখন রেগেমেগে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেন আসেনি? তখন স্ত্রী বললো, তুমি নাকি কাল বাজার থেকে করোলা আনছো? এখন কাশাকাশিও নাকি পাদের মতো বিষয় হয়ে গেছে।

গতরাতে বন্ধুদের কাছে জানতে চাইলাম, যদি কোভিড ১৯ ভাইরাসটাকে আমরা দেখতে পেতাম তবে কি করতাম? এমন প্রশ্ন করে যৌক্তিক এবং বাস্তবসম্মত কিছু মন্তব্য আশা করেছিলাম। যেসব মন্তব্য পেয়েছি তার বেশিরভাগই ছিল হাস্যরসে ভরা কিংবা নিতান্তই কল্পনাপ্রসূত। পুনরায় উপলব্ধি করলাম, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি অ্যাকটিভ থাকে তাদের অধিকাংশেরই রসবোধ খুব প্রবল আর চিন্তার জায়গাটা বেশ দুর্বল। গভীরতা নেই বললেই চলে।

এই একটা ট্রেন্ড চলতেছে। এখানে যতটা প্রম্পট লাইক কমেন্ট করে বসে পাঠকেরা, মাঝে মাঝে মনে হয়, লেখাটার মর্মার্থ বোঝার জন্য ততটাও প্রয়োজনীয় সময় তারা নেয় না। ফলে কখনো কখনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে একটা গুজবের সৃষ্টি হয়ে যায়। একবার এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে কনের সাথে ছবি তুলে পোস্ট করেছিলাম। সাথে সাথে একজন অভিনন্দন জানিয়ে ফেললো। তার দেখাদেখি অভিনন্দন এগিয়ে যেতে থাকলো হাজারে হাজার।

পরে কয়েকটা মেয়ে বন্ধু আমাকে ব্লকও করে দিলো। ঢাকায় ফেরার পর কতজন যে অভিযোগ করলো, বিয়ে করেছি দাওয়াত কেন দিলাম না! বোঝেন অবস্থা!

আসল বক্তব্যে আসি। ভাইরে, করোনা দেখা যায় না! এটা দেখা গেলেও কি আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম? গেল বছর যে শয়ে শয়ে মানুষ ডেঙ্গুতে মারা গেল, আমরা কি সেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি? ডেঙ্গুর বাহককে তো আমরা দেখতে পাই। অরিজিন কোথায় সেটাও জানি। এই যে রাজধানী ঢাকা এখন অনির্দিষ্ট কালের জন্য অনানুষ্ঠানিক শাটডাউন। এখন কিন্তু প্রকৃত সময় ও সুযোগ তৈরি হয়েছে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে ড্রাস্টিক মেজার নেয়ার, তাই না?

সিটি করপোরেশন এখন করোনা নিয়ন্ত্রণে ঔষধ ছিটাচ্ছে। যে মেশিনে করে সেই ঔষধ ছিটাচ্ছে সে মেশিনগুলো কি মশার ঔষধ ছিটানোর ওই একই মেশিন? খেয়াল করে দেখেছেন? যারা এ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের কাজে এখন বিজি হয়ে আছে, তারা কি নতুন করে নিয়োগপ্রাপ্ত? নাকি ওই মশার ঔষধ যারা ছিটাতেন, তারাই? তাহলে তারা কি ডবল ডিউটি করছেন? খবর নিয়েছেন কোনো? করোনা মোকাবিলা করতে আপনাকে কিন্তু ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া গেছে। কারণ এটাকে দেখা যায় না কিন্তু ডেঙ্গুর নিয়ন্ত্রণে আপনাকে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া সম্ভব?

দৃশ্যমান শত্রুকেই আপনারা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে অদৃশ্য শত্রুকে মোকাবিলা করা সম্ভব, সে আশা করেন কিভাবে? করোনায় মারা গেছে কতজন আর ডেঙ্গুতে কতজন? ডেঙ্গু আর আসবে না? মানুষ মরবে না? উপসর্গ তো ওই জ্বরই, নাকি? মনে নাই কদিন আগেই এক লাখেরো বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। আর মারা গেছে কতজন তার হিসাবও সরকার যা বলেছে, তাই-ই। সুতরাং করোনা পরিস্থিতি নিয়ে অযথা প্রশ্ন করে বিব্রত করবেন না।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী