করোনায় বেঁচে গেলেও কেউ কেউ অভাবে মরবে

লতিফ জোয়ার্দার

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৯, ২০২০

করোনাকাল ১
আমার কোনো সঞ্চয় নেই। আগামীর জন্য কোনোদিন কোনো ভাবনা করিনি কখনো। ভেবেছি, দিন তো চলে যাচ্ছে। আর সামনের দিনগুলোও হয়তো একভাবে চলে যাবে। তাই যেত, তাই যাচ্ছিল। অসুখ-বিসুখ মহামারি এসব নিয়ে কেন জানি না কোনো প্রকার ভাবতে ইচ্ছে করেনি কখনও আমার। যখন যা প্রয়োজন কী করে যেন সেটাই ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমার এই বাউণ্ডুলে জীবনে আর কি চাই। যা পেয়েছি তা কী যথেষ্ট নয়!

কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের ওহান প্রদেশে করোনা প্রাদুর্ভাব শুরু হলো। ছোঁয়াচে এই রোগে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করতে থাকলো। এক দেশ থেকে আরেক দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়তে থাকলো। প্রতিদিন কিছু মানুষের আতঙ্ক মাখা মুখ দেখি আমি টিভির পর্দায়। কেউ কেউ বলতে থাকলো, আমাদের দেশে করোনা আসবে না। কিন্তু আমার ভয় হতো। যদি আমাদের দেশে আসে, তবে আমাদের মতো মানুষগুলোর কি হবে? যাদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেলে তারা কাউকেই বলতে পারবে না। যারা সামান্য রোজগারি মানুষ। জানুয়ারি গেল, ফেব্রুয়ারি গেল, মার্চে এসে আমাদের দেশে করোনা নির্ণয় হলো। প্রথম রোগীর মৃত্যু হলো। সমস্ত দেশে হাহাকার শুরু হলো। স্কুল-কলেজ বন্ধ হলো। সাধারণ ছুটি শুরু হলো।

আমার হাতে যে টাকা-পয়সা ছিল, তা দিয়ে বাজার করা শুরু করলাম। চাউল ডাউল তরিতরকারি। আমি যে ব্যবসা করি একদিন বন্ধ হয়ে গেল। ট্রেন বাস বন্ধ হয়ে গেল। সব মানুষ ঘরে আশ্রয় নিলো। বিশ্বজুড়ে সব মানুষের বাঁচার লড়াই শুরু হলো। আমারও ঠিক তাই হলো। কিছুটা লেখালেখির অভ্যাস আছে আমার। ভেবেছিলাম ছুটির দিনগুলোতে লিখবো আর পড়বো। কিন্তু তার কিছুই হলো না। কারণ করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকলো। মনে হতে থাকলো এ যাত্রায় আর আমাদের রক্ষা নেই। মার্চ চলে গেল এপ্রিল এলো। আরো ভয়াবহ অবস্থা শুরু হলো চারদিকে। গরিব মানুষের জন্য রিলিফ সুবিধা দেয়া শুরু হলো। রাস্তায় পুলিশ সেনাবাহিনীর টহল চলছে। ঘর থেকে বেরুবার কোনো উপায় নেই। ওদিকে আমার বাজার শেষ হয়ে আসছে। বড় জোড় আর এক সপ্তাহ চলতে পারে।

সর্বশেষে আমার হাতে এখন মাত্র আটশো টাকা আছে। কারো কাছে আমার মতো মানুষ হাত পাততেও পারবে না। কিন্তু ভয়াবহতা আমায় ডাকছে। কী হবে, তার কিছুই জানি না। তবুও ভাবছি আমার মতো হাজার জনের কথা। যাদের জন্য কোনো সাহায্য নেই। প্রণোদনা নেই। যারা বুকে পাথর চাপা দিয়ে বসে আছে, তাদের কী হবে! তারা কেউ কেউ করোনাই বেঁচে গেলেও, নীরব চাপা অভাবে মরবে। যদি আর কিছুদিন কর্মহীন থাকতে হয়। তবুও ভাবছি এতদিনের মতো অচেনা কেউ এসে এবারও উদ্ধার করবে আবার। আবার বাঁচবো আমরা।

করোনাকাল ২
১৮২০ সাল। ভয়াবহ কলেরা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীতে। তার ভয়াবহতার ব্যাপকতা ছিল দীর্ঘদিন। প্রায় ১৪০ বছর পর কলেরা পুরোপুরি নির্মূল সম্ভব হয়েছিল। তখন মৃত্যু উপত্যকায় বসবাস করেছে মানুষ। অসংখ্য মানুষের প্রাণহানির মধ্যে দিয়ে আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছে জীবন সেতু। অতঃপর ১৯২০ সালে আমাদের দেখা হয় গুটি বসন্তের সাথে। আরো বেশি ভয়াবহতা নিয়ে তার উপস্থিতি পুরো পৃথিবীকে নাড়িয়ে দেয়। সর্বকালের সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে গুটিবসন্তে। গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাব ছিল প্রায় ৫০ বছর। সেসব দিন জয় করেছে মানুষ।

এই করোনাকালে এসব কথা বলছি যে কারণে, আমাদের পূর্বপুরুষেরা মহামারির সাথে লড়াই করতে অভ্যস্ত ছিল । তবে আমরা ইতিহাস ভুলে যাই বলে, আমাদের এই দুর্গতি। ভয়কে আজ আমাদের জয় করতে হবে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মোকাবেলা করতে হবে বর্তমান অবস্থা। পুরো বিশ্বের দিকে চোখ রাখতে হবে। যারা করোনাকে জয় করেছে, তাদের থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কোনো অবস্থায় মহামারিকে অবহেলার চোখে দেখলে চলবে না। মহান সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই বিজ্ঞানীদের চোখ খুলে দেবেন। আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে আরও একটি নতুন প্রভাত।

করোনাকাল ৩
গতরাতে একটা স্বপ্ন দেখে সকালবেলায় মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছে ছিল স্বপ্নটা কাউকেই জানাবো না। তবুও বউকে বললাম, মিনু ঘরে যে চাউল আছে কয়দিন চলবে? মিনু বললো, চাউল তো শেষের দিকে। আর দুই একদিন চলতে পারে। তখন আবার স্বল্পদীর্ঘ স্বপ্নের কথা মনে হলো। একটা দুর্ভিক্ষের দেশে বসবাস করি আমি। যারা চাউল মজুদ করেছিল, তাদের ঘরে ছাড়া আমাদের মতো কারো ঘরে কোনো চাউল নেই। বাজারের একটা ঘরের সামনে দীর্ঘ লাইন। সেখানে দশ টাকা কেজি দরে সরকারি চাউল বিক্রি হচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমার সামনে পঞ্চাশজনের বেশি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে তখনও।

বউ আবার আমার সামনে এলো। জিগেশ করল, কি হলো এমন করে বসে রইলে যে। এ সময়ে বসে না থেকে ঘরের কিছু কাজ তো করতে পারো। আমি বললাম, দ্যাখো, দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলো। কেন রাতের বেলায় যখন একসাথে ঘুমাও তখন তো দুরত্ব বজায় রাখো না তুমি। করোনাকাল সবার না তোমার একার। কেউ তো আর ঘরের বাইরে যাওয়া বাদ রাখছে না। আড্ডা দিচ্ছে, বাজার ঘাটে যাচ্ছে। সবাই তোমার মতো নয়! নিজের কাজ করছে সবাই। আর তুমি আজ একমাস দোকান বন্ধ করে বসে আছো। যে বাজার আছে ফুরালে কি খাবে সে চিন্তা আছে তোমার?

তখন আমার মনে হলো, বউ তো ঠিকই বলেছে, আমাদের মতো মানুষ করোনাকালে মহাবিপদে আছে। যাদের প্রতিদিন রোজকার করে খেতে হয়। অথবা যারা সংসার চালিয়ে বাড়তি কোনো সঞ্চয় রাখতে পারেনি। যারা আমার মতো বাউণ্ডুলে। যারা সাহিত্য চর্চা করে। সঙ্গীত চর্চা করে মহাভারত উদ্ধার করবে।

তখন থেকে আমার চিন্তা, এই ২০ কোটি জনসংখ্যার দেশে, গরিবেরা রিলিফ পাবে। ধনীরা প্রণোদনা পাবে। সরকার আমার মতো লোকদের সাহায্যের কথা বললেও কী তারা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে পাঁচ কেজি চাউল কিনবে। আর শুধু চাউল দিয়েই তো সংসার চলে না। আমাদের মতো যারা আছে তারা এই করোনাকালে ভাইরাস থেকে যদিও বাঁচে। কিন্তু অভাবে ঠিকই মরবে।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক