কলকাতা নিয়ে কিছু কথা
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ০২, ২০১৯
কলকাতা গেলে আগে দুটো কাজ ছিলে নির্ধারিত। ফাইন আর্টস একাডেডিতে গিয়ে নাটক দেখা, আর কলেজ স্ট্রীটে গিয়ে বই কেনা। নাটক দেখতে এখন আর যাওয়া হয় না তেমন। কিন্তু কলেজ স্ট্রীটে নিয়মিত যাই বই কিনতে। কলকাতায় গেলে আগে সাধারণত থাকা হতো রাসবিহারী এভিনিউ ও দেশপ্রিয় পার্কের কাছাকাছি। পনেরো বছর ধরে থাকি সল্টলেক এলাকায়। সল্টলেক থেকে আগে কলেজ স্ট্রীটে যেতাম সাধারণত ট্যাক্সি নিয়ে। আমার বন্ধুর ছেলে কুশল আমাকে নতুন পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছে সস্তায় কলেজ স্ট্রীটে যাতায়াতের। সল্টলেক থেকে শেয়ারে অটোতে করে প্রথম ফুলবাগান যেতে হবে; ফুলবাগান গিয়ে রাস্তা পার হয়ে আরেকটা শেয়ার অটোতে কলেজ স্ট্রীটে বাটার মোড়। সেখান থেকে সামান্য হাঁটলে কলেজ স্ট্রীটের বইয়ের দোকান, কফি হাউস, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। সল্টলেকের যেখানে আমি থাকি সেখান থেকে শেয়ারে ফুলবাগান যেতে বারো টাকা আর ফুলবাগান থেকে কলেজ স্ট্রীট এগারো টাকা। ব্যাস, তেইশ টাকার মামলা। কিন্তু ট্যাক্সিতে কম করে একশো বিশ টাকা। ফলে সময় বাঁচে, খরচ বাঁচে। ট্যাক্সির পাবার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। অবশ্য কলেজ স্ট্রীট থেকে একসঙ্গে অনেক বেশি বই কিনলে বা বৃষ্টি নেমে পড়লে ট্যাক্সি নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
বলছিলাম শেয়ার অটোর কথা। শেয়ার অটো মানে বাংলাদেশে সাধারণত কথ্যভাবে যেগুলিকে সিএনজি বলা হয়। সারা কলকাতা শহরে এরকম শেয়ার অটো রয়েছে। এ ব্যবস্থায় কলকাতার মানুষের যাতায়াতের সুবিধা হয়। বলা যায়, এটা কলকাতার অন্যতম পরিবহণ সংস্কৃতি। শেয়ার অটোতে পিছনে তিনজন বসে, আর সামনে চালকের পাশে কোথাও একজন কোথাও দুজন বসে। কখনো তিনজন বসতে দেখা যায় চালকের সামনে। শেয়ার অটোতে যে খুব সাধারণ মানুষরা যাতায়াত করে, তা নয়। বহু পয়সাওয়ালা ঘরের নারী পুরুষ, তরুণ-তরুণীরা তাতে যাতায়াত করে। দুটো গাড়ির মালিক এমন পরিবারের অনেকে এসব শেয়ার অটোতে যাতায়াত করে। ঢাকার বা বাংলাদেশের মানুষদের কাছে বিস্ময়ের লাগতে পারে যখন দেখবেন, শিক্ষিত স্বচ্ছল পরিবারের চকচকে মহিলারা এরকম শেয়ার অটোতে করে কোথাও চলেছেন, সম্পূর্ণ অচেনা পুরুষদের সঙ্গে গাঘেঁষে বসে। হয়তো খুব হতবাক হবেন, যখন দেখবেন নির্দ্বিধায় তারা চালকের গাঘেঁষে বসে রয়েছেন। বহুবার দেখেছি, চালকের দুদিকে দুজন মহিলা বসে দিব্যি চলেছেন তার গন্তব্যে। সামান্য দ্বিধা দ্বন্দ্ব কিছু নেই তাদের আচরণে। না বড়োলোকি ভাব, না নাক সিঁটকানো। আমার পাশে এক মহিলা কত সময়ে গাঘেঁষে বসে নিজের গন্তব্যে চলেছেন। কী যায় আসে তাতে আমাদের চলার পথে! বাংলাদেশের শিক্ষিত স্বচ্ছল পরিবারের মহিলারা সাধারণভাবে এসব ভাবতেই পারবেন না। বিশেষ করে যারা দু]দুটো গাড়ির মালিক তারা এভাবে কোথাও যাবেন! ব্যতিক্রম ভিন্ন কথা। কলকাতার শিক্ষিত স্বচ্ছল মানুষগুলোর দিকে তাকালে বুঝতে পারি, আমাদের দেশের স্বচ্ছল মানুষদের নাক উঁচু ভাবটা বেশি, কলকাতার তা নয়। কলকাতার বহু ধনীরা রাস্তায় বসে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ফুচকা বা নানারকম খাবার খেয়ে ফেলবে। মানসম্মান যাবে না তাদের। পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রীদের সঙ্গে, বিধায়কদের সঙ্গে বসে সাবলীলভাবে মাটির ভাড়ে চা খাবার অভিজ্ঞতা আছে আমার নিজেরই। কলকাতার আরেকটা দিক হচ্ছে, এখানকার দরিদ্র মানুষদের রয়েছে আবার অনেক বেশি আত্মসম্মানবোধ। বিভিন্ন বাসায় যারা রান্না করেন, ঘরদোর পরিষ্কার করে; তাদেরকে সম্মান দেখিয়ে কথা বলতে হয়। বাংলাদেশের মতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা যায় না। ফকিরনী বলে গাল দেয়াটা তো দূরের কথা। মারধর পরের প্রশ্ন, সেটা এখানে ব্যতিক্রম বলে বিবেচিত হবে। শিক্ষিতরা এখানে দরিদ্রদের, গৃহকর্মীদের সম্মান দেখাতে জানে। বাংলাদেশের শিক্ষিত স্বচ্ছল পরিবারের মানুষরা যা বলতে গেলে এখনো শিখতেই পারেনি। বিশেষ করে যাদের হালে বেশ টাকা পয়সা হয়েছে, শিক্ষার বড় সনদপ্রাপ্ত হয়েছে মাত্র প্রথম দ্বিতীয় প্রজন্ম।
কিছুক্ষণ আগে অটোচালকদের কথা বললাম, তাঁদের মধ্যে অনেকে স্নাতক। তার চেয়ে উচ্চশিক্ষিত আছে কিনা, জানি না। সবার সঙ্গে তো আর কথা হয় না। কম শিক্ষিত আর বেশি শিক্ষিত হোক, নিজের কাজ নিয়ে লজ্জিত নন তারা। মাথা নত করে থাকেন না তার গ্রাহক বা যাত্রীদের সঙ্গে। সর্বক্ষেত্রে একটা পেশাদার ভঙ্গি গড়ে উঠেছে। সকাল বেলা আমার বন্ধুর বাসায় চা খেতে এক তরুণের সঙ্গে গল্প হচ্ছিলে আজ। আগেও দেখেছি। ঠিক আমার উল্টোদিকের সোফায় বসে চা খাচ্ছিলে। খবর কাগজ পড়ছিলাম আমি ‘আজকাল’। আমার পাশে রাখা আনন্দবাজার। ছেলেটা বললো, কাকু আনন্দবাজার কাগজটা পড়তে পারি? কাগজটা এগিয়ে দিলাম। চা খেয়ে আমার সঙ্গে দু’একটা কথা বলে চলে গেল ছেলেটা। রান্নার যে মহিলা রয়েছে এ বাড়িতে রমা, বলা যায় এ বাড়ির একজন সদস্য; আমাকে বললে, দাদা ছেলেটা খুব মেধাবী, স্নাতক সম্পন্ন করে অন্য কিছু নিয়ে পড়াশুনা করছে। কিন্তু এখানে মালির কাজ করে, ছাদের গাছগুলো দেখাশুনা করা পরিষ্কার রাখা ওর দায়িত্ব। বাংলাদেশে ভাবতে পারবে কেউ, বাংলাদেশে একজন মালি আমার সঙ্গে এক সোফায় বসে চা খাবে আমাকে দেয়া একইরকম বিস্কুট দিয়ে। ধরা যাক রমার কথা। রমা এ বাসায় রান্না করে, ঘরের দেখাশুনা করে। চারটার পর রমা বিশ্রামে যাবে। তখন ওকে কেউ কিছু বলবে না। কিছু চাইবে না। সাড়ে পাঁচটায় রমা উঠে টেলিভিশন দেখবে, দেখবে নানা ধারাবাহিক। তখন টেলিভিশনটা ওর। আমরা কেউ ওকে বিরক্ত করতে পারবো না। রমা টেলিভিশন দেখার ফাঁকে সুবিধা মতো বিজ্ঞাপন বিরতিতে চা বানিয়ে দেবে বিকেলের। খুব কড়া কিছু নিয়ম নয়, এটা একটা প্রথা। রমা যে একজন মানুষ; তার যে বিশ্রাম দরকার, বিনোদন দরকার, এটা আমার বন্ধু ধূর্জটি আর শ্রীলেখা ভিতর থেকে অনুভব করে। সম্ভবত কলকাতার শিক্ষিতজনরা এটাতে অভ্যস্থ। হয়তো আমার বন্ধুরা বেশি, অন্যরা কিছুটা কম। আমরা এসবে অভ্যস্থ নই। আমার বন্ধুর বাসায় সকালে আর সন্ধ্যায় এসে চা খায় আবার রমার সঙ্গে বসে টেলিভিশন দেখে এখানকার বয়স্ক কেয়ার টেকার। প্রতিদিনের ঘটনা এটা।
নাক সিঁটকানোর কিছু নেই। সবাইকে মানুষের মর্যাদাটাই দেয়া হয়। এটুকুই। কল্পনা, যে দিনের অনেকটা সময় এখানে থেকে ঘরদোর পরিষ্কার করে, সে একইরকম সুবধা পায়। দুপুরে এখানে খাবে, দরকার মতো চা বানিয়ে নেবে, চেয়ারে বসবে আমাদের সামনে। কিছুই নিষিদ্ধ নয় তারজন্য সে ঘরদোর পরিষ্কার করে বলে। সে নিম্নমানের খাবার পাবে না; সবাই যা খায় সে তাই খাবে। কলকাতার এটা একটা স্বাভাবিক চিত্র। সুশ্রুত হাসপাতাল আর ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক নিয়ে আমার লেখা পড়ে যারা খুশি হয়ে বলেছেন, আমার যে বন্ধুরা জানতে চেয়েছেন যে, বাংলাদেশে এমনটা হয় না কেন? বাংলাদেশের চিকিৎসকরা রোগীকে সম্মান দিতে পারেন না কেন, তাদেরকে বলবো, আমরা কি আমাদের ঘরবাড়িতে যারা কাজ করেন, তাদেরকে সে সম্মানটা দিতে পারবো যা কলকাতা দিতে পারে?
ভিন্ন চিত্রটা এবার বলি। যখন শেয়ার অটোতে কেউ ভ্রমণ করে, যখন রেস্টুরেন্টে খায়, কেউ জানতে চায় না পাশের যাত্রী লোকটা বা যার রান্না খাচ্ছি তারা ব্রাহ্মণ কিনা, শূদ্র কিনা, বা যবন কিনা। মুসলমানদের রেস্টুরেন্ট ‘অমিনিয়া’তে প্রচুর ব্রহ্মণদের খেতে দেখা যায়। অন্যরা তো আছেই। রোববারের দুপুরে জায়গা পাওয়া কঠিন অমিনিয়াতে। বিভেদ এসব জায়গায় নেই। মুসলিম পরিবারে জন্মে ব্রাহ্মণ পরিবারে খেতে থাকতে আমার বাধা নেই কলাকাতায়। ব্রাহ্মণ পরিবারের রান্না ঘরে গিয়ে কফি বানাচ্ছি, আবহাওয়া এতটাই সুন্দর। কখনো বুঝবার উপায় নাই, কার কী ধর্ম। কিন্তু রোববারের পত্রিকা যখন দেখি, তখন যেন ভিন্ন এক কলকাতাকে দেখতে পাই, ভিন্ন এক পশ্চিমবঙ্গকে দেখি, যদি কিছু বিজ্ঞাপনের দিকে তাকাই। বিয়ের পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনের দিকে তাকালে মনে হয়, লেখাপড়া শেখা মানুষগুলোর অনেকেই কি মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পেরেছেন? দেখা যাবে সেসব বিজ্ঞাপনে, শিক্ষিত মানুষরাও কতে বেশি চাতুর্বর্ণ বা বর্ণপ্রথার কুসংস্কারে ডুবে আছে। স্নাতক, স্নাতকোত্তর, পিএইচডি করা মানুষরা বর্ণ উচ্চরণ করে পাত্রপাত্রী চাইছে। লেখাপড়া না জানা মানুষদের কথা আলাদা। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত মানুষরা এখনো মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে রেখেছে মনের গভীরে গহীনে। কন্যা বা পুত্রের বিবাহ দেবেন না, বর্ণ না মিললে। কীরকম স্ববিরোধী একটা অবস্থান, শ্রমজীবী মানুষটাকে সম্মান দিচ্ছে, কিন্তু শিক্ষিত স্বচ্ছল একজন মানুষও যদি তার বর্ণের বাইরে জন্মে থাকে তাহলে বিবাহ হবে না। নিশ্চয় এটা সর্বজনীন নয়, সকলের বিশ্বাস নয় কিন্তু অনেক মানুষের বিশ্বাস। দেখা যাচ্ছে খাবার বেলায়, মেলামেশা করবার ক্ষেত্রে বর্ণ নিয়ে সেই আগের মাতামাতি নেই, কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রে রয়ে গেছে অনেকটাই আধুনিক কলকাতা শহরে। শিক্ষিতদের মধ্যেই থেকে গেছে। ভূতের ভয়ের মতো, বিবাহ দেবার বেলায় এ সংস্কার যেন যাবার নয়। নিশ্চয় এরা অনেকেই রবীন্দ্রভক্ত। কিন্তু বর্ণপ্রথা মেনে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মূল দর্শন মানুষে মানুষে মিলবে কী করে?
হয়তো মনে হবে এটা ক্ষুদ্র ব্যাপার, কিন্তু তা নয়। যারা বহুদিন ধরে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে চলেছে বিরাট ভারতে, এসব ঘটনায় তারা প্রচ্ছন্নভাবে হলেও প্রশ্রয় পাবে। সুখের খবর এই যে, তবে এটা সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কলকাতা, সারা পশ্চিমবঙ্গ এসব সংস্কার অনেকখানি ভেঙে ফেলেছে। রয়ে গেছে অনেকখানি। বামফ্রন্টের জমানায় বহু কিছু দেখেছি, তাদের নেতা আর কর্মীদের মধ্যে যা ভয়াবহ কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। কুসংস্কার দূর করা খুব সহজ কাজ নয়। বামফ্রন্ট সে চেষ্টা সেভাবে চালিয়েছে বলে মনে হয় না। বামফ্রন্টের অনেক ইতিবাচক কাজের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, মানুষের মধ্যে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তারা মতাদর্শগত সংগ্রামটা চালায়নি। বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তায় মানুষকে যে তারা প্রভাবিত করতে পারেনি, তার প্রমাণ এখন নানা ঘটনায় অনেকেই পাবেন। তারপরেও বলতে হবে, কলকাতার মানুষের মধ্যে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন তারাই এনেছিলে। যার ফল এখন ভোগ করছি।