উমা কাজী

উমা কাজী

কলকাতায় বাঙালি মুসলিমের ব্রাত্য হওয়ার টুকিটাকি

অতুন সিংহ

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৬, ২০২০

কাজী নজরুল ইসলামের পুত্রবধূ ও বাচিক শিল্পী কাজী সব্যসাচীর স্ত্রী উমা কাজী আর নেই। ঢাকার বনানীর বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। স্বার্থপর বাবুদের হিন্দি-উর্দুর দালাল শহর কলকাতা ছেড়ে কাজী নজরুলের সঙ্গে ঢাকায় চলে যেতে হয়েছিল উমা কাজী ও তাঁর পরিবারকে। তাঁর দুই কন্যা খিলখিল কাজী ও মিষ্টি কাজী আজও জীবিত। মিষ্টি দিদি কলকাতায় নজরুলের ফ্ল্যাটে এসে বসবাস করেন মাঝেমধ্যে। সেই ফ্ল্যাটে আমি দুবার গেছি মিষ্টিদির সঙ্গে কথা বলতে। দেখেছি, পায়রার খোপের মতো সেই ফ্ল্যাট।

এ বিষয়ে কথা প্রসঙ্গে সমাজ-রাজনীতি চলেই আসে। কলকাতায় বাবু বাঙালি হিন্দুরা মাড়োয়ারি-গুজরাতি হিন্দুর দালালি করে এবং বাঙালি মুসলমানকে `অপর` প্রক্রিয়ার মধ্যে ফেলতে বাঙালি মুসলিমের বড় অংশকে ৪৬ থেকে ৯১ অবধি নানা সময়ে উর্দুভাষী বিহারী-হিন্দুস্তানি মুসলিমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে খেদিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। এর কারণ মুসলিম বলতেই কলকাতা উর্দুকে বোঝাতে চেয়েছে, যাতে বাঙালি হিন্দুর সাথে বাঙালি মুসলমানের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, এবং ইসলাম প্রীতির নাম করে সামান্য সংখ্যক উর্দুভাষী মুসলিমদের রাজনৈতিক ক্ষমতায় এনে পশ্চিমবঙ্গের এক তৃতীয়াংশ জনগণ যারা বাঙালি মুসলিম তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ণকে দূরে ঠেলে রাখা যায়।

এই কারণে পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলোয় বাঙালি মুসলিমের সংখ্যা প্রভাবশালী হলেও কলকাতায় মুসলিম বলতেই উর্দুভাষী। কারণ কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। রাজ্যের ক্যাপিটাল সিটিতে বাঙালি মুসলিমদের ব্রাত্য করে রাখাটাই বকলমে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি রাজনীতির দালাল বাবু বাঙালির প্রোজেক্ট। এই শয়তানি কংগ্রেসের, সর্বপ্রকার বামেদের এবং কিছুটা তৃণমূলেরও। কারণ এরা প্রত্যেকেই কম বেশি বাংলা বিরোধী এবং হিন্দিয়ান প্যানইন্ডিয়ার রাজনীতি লালন করে। বাংলায় বাঙালির ক্ষমতায়ণ হলেই যেহেতু নমঃশূদ্র বাঙালি আর বাঙালি মুসলিমের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রসারিত হবে! এই রাজনীতির হাত ধরেই দেখবেন এনআরসি ও ক্যা বিরোধী আন্দোলনে মুসলিম বলতেই উর্দুভাষীদের বোঝাচ্ছে হিন্দি-উর্দুর দালাল বাবুরা।

বাংলার মাটিতে আন্দোলন হচ্ছে, অথচ স্লোগান হচ্ছে হিন্দি আর উর্দুতে। এমনই একটি দালাল পার্টি লিবারেশনের এক ক্যাডার সেদিন বললো, হিন্দি-উর্দুতে স্লোগান গোটা ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য! হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগে অমিত শাহও কিন্তু এই ঐক্যবদ্ধ করার লজিক সামনে এনেছিলেন। আসলে এই পরোক্ষ ভাজপা দাললরা মনে করে, হিন্দি-উর্দু মানেই ভারত! আসলে তারা ভুলে যায়, ভারতে বরং হিন্দি-উর্দুই কম মানুষের ভাষা। এগুলো শাসকের বানানো ভাষা। বরং ভারত মানে বাংলা, তামিল, তেলেগু, মালায়লি, কন্নড়, মারাঠি, পঞ্জাবি, সাঁওতালি, মাগধী, ব্রজবুলি, ওড়িয়া ইত্যাদি।

সে যাই হোক, নজরুলের পরিবারকেও একভাবে কলকাতায় ব্রাত্য করে রাখাই হয়েছিল পরোক্ষে। বর্ধমানে গ্রামের বাড়িতে তিনি ফিরে যেতে পারতেন কিন্তু সেই অবস্থা তাঁর ছিল না। ৪৭ পরবর্তী সময়ে কলকাতায় জীবিতবস্থায় প্রাপ্য কিছুই জোটেনি তাঁর। তাই বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। সেখানেই ছিলেন উমা কাজী। আমাদের পশ্চিমবাংলার মেয়ে। অনেক আগেই নিজের এলাকা ছেড়েছিলেন। দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। বিদায়। প্রণাম। সালাম। পরকাল আছে কি না জানি না, যদি বেহেস্ত বা স্বর্গ বলে কিছু থাকে আল্লাহ সেখানে নিশ্চই আপনাকে জায়গা দিবেন। কিন্তু আপনি ও আপনার পরিবারের সবাই চরাচর বাংলার সকল মানুষের মনে ছিলেন, আছেন, থাকবেন।

লেখক: কবি