কাউসার মাহমুদের গদ্য ‘অন্তর্নিহিত স্বর ও উপলব্ধিতা’
প্রকাশিত : এপ্রিল ১৪, ২০২০
কোনও একদিন ভেবেছিলাম, মানুষের এই অহেতুক মচ্ছব ছেড়ে, জীবনের সমস্ত ক্লান্তি আর গ্লানিবোধটুকু ঝেরে ফেলে পাহাড়ে চলে যাব। সুদীর্ঘ সবুজ ও ব্যাপ্তিভরা এই দীর্ঘকায় সৃষ্টিটি বরাবরই টেনেছে আমায়। আসলে প্রকৃতির সবই তো মোহাচ্ছন্নর মতো আকৃষ্ট করেছে আমায়। মনে আছে, শৈশবে বৃষ্টি পড়লে কচু পাতাকে আমার সবচেয়ে রূপবতী মনে হতো। মনে হতো, অখণ্ড সবুজের উপর এই যে একবিন্দু জল, যেন পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে অম্লান টলোমলো হয়ে আছে। ভালো লাগতো শ্যাওলার পুকুর, ধু ধু মাঠ আর অবিস্তীর্ণ ক্ষেতের আল। মূলত মানুষের বিচ্ছিন্ন পদচ্ছাপই আমাকে জনারণ্যের মাঝে আরেকটু কৌতূহলী করে তুলেছিল; এর কি হেতু আমি জানি না। যেমন জানতাম না আমার দাদির ঘরে, কয়লা রাখা গোল ওই মৃৎপাত্রটির অনবরত জ্বলে যাওয়ার হেতু। আগুনই তো সবচেয়ে কঠোর। তাকে যেখানে রাাখা হয়— সে কীরূপ সহ্যমান! এই ভেবে ভেবে কতদিন যে আমি শীতের সন্ধ্যায় ডুবে গেছি, তার অন্ত নেই। যেন পশ্চিমের ভেজা সূর্যটি, লজ্জায় আনত হয়ে আমাকে কোলে তুলে নিত, আর ফেলে দিত কোনও অসীম রাত্রির ভেতর। যার উপর ঘনায়মান কুয়াশার আঁচিলে ছড়িয়ে পড়তো মুহুর্মুহু শীতলতা। মূলত তখনও এই অপার উপলব্ধি ও স্নিগ্ধতার মাঝে আমাকে ডাকতো পাহাড়ই।
এমন স্থৈর্য, এমন অকুতোভয় সুদীপ্ত কণ্ঠস্বর তার! যদি কোনওদিন কেউ তার চূড়ায় গিয়ে কান না পাতে, সমস্ত অনভূতি একীভূত করে না শোনে তার শ্বাশত শান্তস্বর; বাতাস যেখানে আলুলায়িত হয়ে বিছায়ে দেয় তার সকল আকাঙ্খা ও দোলায়িত সারনির্যাস; সে কোনওদিন বুঝবে না পাহাড়ের মায়াময়তা। মানুষ ও সকল সৃষ্টির প্রতি তার স্নেহার্দ্রতার নিরবিচ্ছিন্ন কথা। ভূ-পৃষ্ঠতল থেকে জড়িত তার সকল বিচ্ছিন্নতাই এক অপূর্ব অপূর্ণতা মনে হয় আমার। যেন দ্বিতীয় জন্মের অনুমতি পেলে পাহাড়ই হতে চাইতাম। এমন উড্ডীন অথচ চূড়ান্ত নমনীয়। এ কি অন্য কোথাও পাওয়া গেছে! তার ভাঁজে, প্রান্তদেশজুড়ে কখনো যে ফুল-মল্লিকার ছোট্ট মুকুল উঁকি মেরে থাকে— তা কি নিসর্গতা নয়? এমন স্তব্ধ ও শক্ত বুকের উপর; যে ফুল ফোটায়, যে লালিতভাব ও কমনীয়তা ছড়ায়ে থাকে সেখানে, তা কি মানুষের গোপন মুখাঙ্গরাগ থেকে শ্রেয়তর, মুখরিত নয়। মূলত মানুষ জীবনের পথে সবচেয়ে বেশি আঘাতগ্রস্থ হয় তার স্ব-জাত দ্বারাই। তাই মানুষের আচ্ছাদিত বিপ্রতীপতার বিরুদ্ধে সবসময়ই আমাকে টেনেছে ওই নির্বিঘ্ন-নিঝঞ্ঝাট পাহাড়।
যেখানে আদিম ও পৌরাণিক সভ্যতাসমূহের সমস্ত রাগসঙ্গীতে মূর্ছা যাব আমি। ভেসে যাব জোছনা খলবল সুপ্তির ভেতর। কখনো মনে হয়, যেমন এই এখনো! এ কি অলীক কল্পনা আমার? তখন দূরাগত কোনও মায়াস্বর ডেকে বলে, `মোটেই না।` এবার আমার বিশ্বাস স্থিত হয়। ভাবি, মূলত সমস্ত সুর ও ধ্বনিত সকল কিছুই তো আমার অন্তর্লোকজুড়ে ছড়িয়ে আছে। যে সুর আমার— তা তো আমারই। আর যা প্রাচীন, পৌরাণিক; তা আস্বাদনে আমার আছে এক শিল্পীত সতৃষ্ণ আত্মা। আমি জানি এ এক অতৃপ্য মোহমত্ততা। কোনও কালেই আমি যাকে অনৃত ভাবতে পারিনি। শুধু তার মরণোন্মুখ বিমুগ্ধতা কাটাতে চেয়েছিলাম। যেন নিজেরে কোনও অরূপের ভেতর লীন করে দিয়ে পাহাড়ের ওই একখণ্ড রূপের ভেতর পুনর্জনন্ম নেব। আর আমার সমস্ত বিবশতা বশীভূত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে আমার নির্জীব পরমাত্মার উপর। পাহাড়ে, কোনও গুহার সম্মুখে আমার আত্মার বিসর্জনে ফুটবে একটি ফুল। শতাব্দীকাল পর কোনওদিন কোনও চন্দ্রাহতও তা দেখে বিস্মিত হবে আর গড়িয়ে পড়বে কোমল সে পাহাড়ের উপর।
জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো চির বাউণ্ডুলে এ আমার আকাঙ্খাই ছিল এমন। গিয়েছিও বহু পর্বত চূড়ায়, বনে-জঙ্গলে। মানুষের কাছে, বাজারে, মজলিসে নৃত্যরত নর্তকি ও উজ্জ্বল পানশালার কাছে। কিন্তু কোথাও যেন থিতু হওয়া হলো না। শুধু এক অচঞ্চল যূথবদ্ধ পদক্ষেপের কাছেই বারবার নত হতে হয়। যেন এই অগ্রসর দৌড়, সবকিছু জিতে মহিম হয়ে ওঠা— ওসব আমাকে তুচ্ছই করে। আমাকে বরং ডাকে অসীম নির্লিপ্ততা ও নিঃসঙ্গতা। তাই সমস্ত সমীকরণ এক করে দেখলাম, যেহেতু মানুষের কূটচাল ও বৃহত্তর সন্ধিগ্ধতা আমি দেখে ফেলেছি, জেনে ফেলেছি সত্য ও প্রলেপের গোপন আচ্ছাদন; সুতরাং আমার এ করুণ সত্য উপলব্ধির কাছে মানবীয় সমস্ত আয়োজনই বৃথা ঠেকবে। তাই ওই দীর্ঘ অহিংস পাহাড়ই আমার আজন্ম আশ্রয়। আমার একান্ত ঋষিকাল যাপনের সমূহ সুখের জয়গা। যেন আমার অন্তর্ধান ওখানেই, প্রকৃতির কোলে, স্রষ্টার পায়ে নির্বিঘ্নে। আপাত এই প্রার্থনায়।
লেখক: কবি
























