কিছুই যখন করার থাকে না, মানুষ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০২০

একজন সংবাদকর্মী হিসেবে প্রতিদিনই করোনা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ হাতে আসছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে ফোন আসছে। নিরুপায় মানুষজন সবদিক থেকে নানামুখি তথ্য পাচ্ছে, এরমধ্যে কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক সেটা নিয়ে তারা রয়েছে বিভ্রান্তিতে। আমাদের ফোন করে বা ফেসবুকের ইনবক্সে জানতে চাওয়া হয়, দেশের আসল পরিস্থিতি কি? করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে আমাদের সরকারের সক্ষমতা কেমন?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা তাদের প্রশ্নের সঠিক কোনও উত্তর দিতে পারি না। কারণ আমরাও সরকারের সরবরাহ করা তথ্যকে সর্বোচ্চ সত্য ধরে নিয়েই সংবাদ পরিবেশন করি। আমাদের কর্তৃপক্ষ যেভাবে আমাদের আশার বাণী শোনাচ্ছেন, আমরা সেটাই বিশ্বাস করছি মনেপ্রাণে। মনকে বুঝ দেই, করোনা আমাদের কোনও ক্ষতি করবে না। we shall overcome one day.

তাই করোনা নিয়ে ফেসবুকে যাই চলুক, আমি ব্যক্তিগত কোনও মতামত দেই না। ঠিক করেছিলাম, এই নিয়ে লিখবও না কিছু। কিন্তু এই মাঝরাতে একটা সংবাদে চোখ আটকে গেল। মনে হলো আর না লিখলেই নয়, কথা বলতেই হবে। সংবাদটি হলো, চিকিৎসকদের পক্ষে ফেসবুকে লিখে দুই শিক্ষক সাময়িক বরখাস্ত। বলা হচ্ছে, নভেল করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের ‘সমন্বিত উদ্যোগের’ মধ্যে ফেইসবুকে ‘উস্কানিমূলক’ বক্তব্য ও ছবি পোস্ট করায় বরখাস্ত হয়েছেন সরকারি কলেজের দুই শিক্ষক।

ময়মনসিংহের গফরগাঁও সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাকিয়া ফেরদৌসী এবং বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের দর্শন বিভাগের প্রভাষক সাহাদাত উল্লাহ কায়সারকে সাময়িক বরখাস্ত করে বুধবার আদেশ জারি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। পাশাপাশি সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী কেন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে না, তা আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে জানাতে তাদের নোটিশও পাঠানো হয়েছে।

কাজী জাকিয়া ফেইসবুকে লিখেছিলেন, “খা, সব খেয়ে ফল (ফেল)। শিক্ষা খেয়েছিস, ছাব্বিশটা ক্যাডার খেয়েছিস, সরকারকে খেয়েছিস, সরকারের সুনাম, অর্জন, স্বপ্ন সব খেয়েছিস। এবার পিপিই খা। সব তোরাই খা। আমাদের লাগবে না। মুখে মাস্ক দিয়ে বসে থাক সব নির্লজ্জ, রাক্ষসের দল। বিপদে পড়লে কোনও অরক্ষিত ডাক্তারের কাছে যাবি না, যদি সামান্য লজ্জা থাকে। আর দেশের সবাই মরে গেলে নিজেরা ঝাড়ুদার ক্যাডারে এবজর্বড হয়ে যাস, আর সেল্ফি দিস।”

সাহাদাত উল্লাহ লিখেছিলেন, “করোনার ভয়ে চাকরি ছাড়ার সংবাদটা বুলগেরিয়ার। বাংলাদেশের ডাক্তার ভাইয়েরা আপনার নিজের জীবন আগে, তারপর আপনার পরিবার, ছেলে মেয়ে, স্ত্রী তারপর অন্যসব। যে দেশ আপনার পেশার মূল্যায়ন করে না সে দেশের জন্য কাজ করে কী হবে। সেখানে তিন দিনের ইউএনও ৫৫ বছরের একজন প্রফেসর ডাক্তারের নিয়ন্ত্রক থাকে, যে কিনা ডাক্তারির ‘ড’ ও জানে না।” সূত্র: বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর।

এবার আসল ঘটনার কথা লিখি। কেন এই দুই শিক্ষক চিকিৎসকদের পক্ষে হঠাৎ লিখতে গেলেন? কেন তাদের এত ক্ষোভ? তারা হয়তো খুব আক্রমণাত্মক ভাষায় লিখেছেন, তবে আমার নিজের কাছেও মনে হয়েছে এই ক্ষোভ প্রকাশ খুব বেশি বাড়াবাড়ি নয়, বরং অসহায় মানুষের নিজের কষ্ট প্রকাশের একটা উপায় মাত্র। মানুষের যখন আর কিছু করার থাকে না, মানুষ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।

করোনার সংক্রমণ নিয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তার বিষয় হচ্ছে, আমাদের যারা চিকিৎসা দেবেন, সেই চিকিৎসকদের নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্যই নেই কোনও পিপিই (personal protective equipment)। আমরা সবাই জানি, করোনা ভয়ানক সংক্রমক এবং এর আগে মাত্র তিনজন করোনা রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে, দুইজন চিকিৎসক এবং একজন নার্স নিজেরাই আক্রান্ত হয়েছেন। কোয়ারেন্টিনে গিয়েছেন আরো প্রায় পঞ্চাশজন স্বাস্থ্যকর্মী। তারচেয়ে ভয়াবহ সংবাদ, একটি বেসরকারি হাসপাতালের পুরা আইসিইউ ইউনিট এখন কোয়ারেন্টিনে। এর একটাই কারণ, তারা সবাই অরক্ষিতভাবে কোন পিপিই ছাড়াই চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন।

তাই পিপিই এর গুরুত্ব কতটুকু সেটা যেকোনো স্বাভাবিক বুদ্ধির ব্যক্তিমাত্রই বুঝবেন। সেখানে যদি প্রজ্ঞাপন জারি করে বলা হয়, চিকিৎসকরা পিপিই ছাড়াই সেবা দিয়ে বাধ্য, আপনার বা আমার মতো সাধারণ মানুষের হতাশ না হয়ে বা ক্ষোভ প্রকাশ না করে আর কি করার থাকতে পারে?

আমরা জানি, যেকোনো জাতীয় দুর্যোগে যারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে সেবা দেন তাদের মধ্যে প্রথমেই থাকেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী আর তথ্যসেবা দেন সাংবাদিকরা। এই করোনার মতো কঠিন সময়ে যখন অন্যরা বাড়িতে থেকেই কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন, এই তিন পেশার লোকেরা অরক্ষিত অবস্থায় ঘরের বাইরে গিয়ে কাজে যাচ্ছেন। নিজেদের আর পরিবারের সবার জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছেন।

এই অবস্থা বিবেচনা করে আজ মহামান্য হাই কোর্ট থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, যেন এই পেশার মানুষদের পিপিই সরবরাহ করা হয়। আর সেই দিনেই আদেশ আসে, চিকিৎসকদের অরক্ষিত অবস্থাতেই সেবা দিতে হবে, না দিলে শাস্তির ভয়ও দেখান হয়। তখন এই অদ্ভুত বার্তা অসহায় মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তুলবে, মানুষ আক্রমণাত্মক কথা লিখবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের আর কি বা করার আছে?

ডেঙ্গু মোকাবেলায় বিশজনের অধিক চিকিৎসকে হারাতে হয়েছিল। আর এই মহামারীর সময় অরক্ষিত অবস্থায় সেবা দিতে গিয়ে বাংলাদেশের মতো দেশ, যেখানে রোগী আর চিকিৎসকের সমতা কোনোকালেই ছিল না, সেখানে একজন চিকিৎসকের মৃত্যুও কতটা সংকট বয়ে আনবে, তা চিন্তা করে অস্থির হতে শিক্ষা ক্যাডার হতে হয় না। আপনার বা আমার মতো অতি সাধারণ মানুষও সেটা কল্পনা করে ভয় পায়, ক্ষিপ্ত হয়।

লেখক: গল্পকার ও গণমাধ্যমকর্মী