কৃষ্ণগহ্বরের প্রথম ছবি ও বিজ্ঞানের সাফল্য

ছায়াবীথি শ্যামলিমা

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৯, ২০১৯

পৃথিবীর বুকের সঙ্গে আমাদেরকে জুড়ে রেখেছে মহাকর্ষীয় বল। যদি এই আকর্ষণ না থাকত তাহলে মানুষসহ ভূপৃষ্ঠের প্রতিটি বস্তুই মহাশূন্যের কোথায় গিয়ে যে পড়ত, তার কোনো হদিশ থাকত না। ভাবুন তো, কী রকম নিঃসীম এই মহাবিশ্বের শূন্যতা! অভিকর্ষ বল একবার যদি তার কার্যক্ষমতা তুলে নেয় তাহলে কী হবে পৃথিবীর অবস্থা!

এই যে ব্যাপারটা, মানে অভিকর্ষ বল, এর ভূমিকা আক্ষরিক অর্থেই সুদূরপ্রসারী। গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র ছাড়িয়ে, ছায়াপথের প্রান্ত পেরিয়ে আরো দূরে বিস্তৃত তার ভূমিকা। আমাদের ছায়াপথ মিল্কি ওয়ে, তার কেন্দ্র থেকে ২৬০০০ আলোকবর্ষ দূরে (2.5x10^20 m) পৃথিবীর অবস্থান। কিন্তু এই বিশাল দূরত্বের বাইরেও মহাকর্ষের প্রভাব আছে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে ইন্টার-গ্যালাক্টিক স্পেস (দুটি ছায়াপথের মাঝের জায়গা) বলে, সেইসব পেরিয়েও বজায় থাকে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ, সেই টানে পরষ্পরের সাথে বাঁধা থাকে একাধিক ছায়াপথ। এই দূরত্বের হিসেব দেয়ার জন্য উদাহরণ হিসেবে অ্যান্ড্রমিডা ছায়াপথের কথা বলা যায়। ২৩ লাখ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত অ্যান্ড্রমিডা ছাড়িয়ে আরো দূরে, সদাপ্রসারণশীল মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তুকণাকে একসাথে ধরে রাখে মহাকর্ষ। অবশ্যই দূরত্ব অনুসারে এ টান কমবেশি হয়, কাজেই এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই, যতদূরেই যাই মহাকর্ষীয় বল একইভাবে কাজ করবে।

ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরও মহাকর্ষের এক আশ্চর্য কীর্তি। সূর্যের থেকেও বেশ খানিকটা বড়ো কোনো নক্ষত্রের ‘মৃত্যু’ হলে তার কণাগুলির মধ্যেকার মাধ্যাকর্ষণ বলের জন্য নক্ষত্রটি নিজের মধ্যে কোল্যাপ্স করে। এই বিশাল ভরের মৃত নক্ষত্রই কৃষ্ণগহ্বর। এই নিজের মধ্যেই কোল্যাপ্স করা, তাও সূর্যের থেকেও ভারি একটা নক্ষত্রের— এ আমাদের রোজকার অভিজ্ঞতায় ভেবে ওঠা কঠিন। সহজ-সরল উদাহরণ দেয়া যাক— ধরা যাক, সূর্যের থেকে দশগুণ ভারি একটি নক্ষত্র নিভে আসছে, কারণ যে হাইড্রোজেন জ্বালানি থেকে তার আলো ও তাপ, তা ফুরিয়ে আসছে। বহু লক্ষ বছর ধরে জ্বলার পরে এক সময় জ্বালানি ফুরোলে এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে (একেই পরিভাষায় সুপারনোভা বিস্ফোরণ বলে) কখনো কখনো তৈরী হয় কৃষ্ণগহ্বর। সূর্যের থেকে অন্তত আটগুণ ভারি নাহলে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হয় না। আবার সুপারনোভা এক্সপ্লোশানের পরেও নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ যা পড়ে থাকে তার ভর সূর্যের তিনগুণের থেকে কম হলে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হয় না।

এক কথায় বলতে গেলে, কৃষ্ণগহ্বর আসলে বিশাল পরিমাণ পদার্থকে ঠেসেঠুসে রাখা এক বস্তুপিণ্ড। ঘনত্ব বোঝাতে আবারো উদাহরণ দেয়া যাক। সূর্যের থেকে দশগুণ ভারি যে, তাকে যদি ঠেসে নিউ ইয়র্ক শহরের চৌহদ্দির মধ্যে পুরে দেয়া হয় তাহলে যেরকম ব্যাপার হবে, একটা ব্ল্যাক হোলের ঘনত্ব অনেকটা সেরকম। কৃষ্ণগহ্বরের মহাকর্ষীয় বল এতই বেশি (কারণ প্রচণ্ড বেশি ভর) যে তা আশপাশের সমস্ত বস্তুপিণ্ডকে গ্রাস করতে থাকে। অন্য নক্ষত্র যদি কাছে চলে আসে তবে তারও সেই হাল হয়। তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা, কৃষ্ণগহ্বরের থেকে আলো পর্যন্ত নিস্তার পায় না। ফলে কৃষ্ণগহ্বর দেখতে ঠিক কেমন— এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন অন্ধকার এক বস্তুপিণ্ডের কথা। চল্লিশ বছর আগে জঁ পিয়ের লুমিনেত কৃষ্ণগহ্বরের রূপ কেমন হতে পারে কম্পিউটার সিমুলেশনে তার একটা ছবি এঁকেছিলেন। তার কেন্দ্র গভীর কৃষ্ণবর্ণ, তাকে ঘিরে উজ্জ্বল সাদার বলয়। সদ্য তোলা ছবিতে কৃষ্ণগহ্বরের যে রূপ ফুটে উঠেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, লুমিনেতের ছবি খুবই কাছাকাছি ধারণাই করেছিল।

সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল, অর্থাৎ সবথেকে বড়ো কৃষ্ণগহ্বর কী? অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনো কৃষ্ণগহ্বরের ভর যদি সূর্যের ভরের অন্তত একশো হাজার (10^5) গুণ হয় তাহলে তাকে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল বলা যাবে। সুপারম্যাসিভই শ্রেণিবিভাগে সবথেকে বড় ব্ল্যাকহোলের জায়গা, এবং এই কৃষ্ণগহ্বরের ভর সূর্যের ভরের কয়েক বিলিয়ন গুণ পর্যন্তও হতে পারে (এক বিলিয়ন = 10^7)। সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল কীভাবে তৈরি হয় সে নিয়ে বিজ্ঞানীদের মতবিরোধ আছে, এবং গবেষণার বিষয়। বলা হয়, সমস্ত ছায়াপথের কেন্দ্রেই একটি করে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল থাকে। আমাদের মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে যেমন স্যাজিট্যারাস এ* নামের সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল আছে। সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল তৈরির একটা থিওরি বলে, ছায়াপথের কেন্দ্রে যখন কোন ব্ল্যাকহোল অবস্থান করে, তখন তা আরো পদার্থ নিজের দিকে টেনে আনে, একে বলে অ্যাক্রিশন। যেসমস্ত বস্তুকণা এভাবে জমা হতে থাকে, সেগুলো কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন দূরত্বে এক একটা বলয়ের আকৃতির পথে জমা হয়, ওই বলয়গুলির পোষাকি নাম অ্যাক্রিশন ডিস্ক। অন্যান্য পদার্থের মতো আরো ব্ল্যাকহোলও এভাবে আকৃষ্ট হয়ে পরষ্পরের সঙ্গে জুড়ে যেতে পারে। এভাবে ক্রমশ বড় হতে হতে একসময় ‘সাধারণ’ ব্ল্যাকহোল সুপারম্যাসিভ বা অতিকায় হয়।

১০ এপ্রিল ২০১৯ এরকম একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল বা অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরের ছবি বিজ্ঞানীরা তুলেছে ইভেন্ট হরাইজন টেলেস্কোপে। এরই মধ্যে প্রায় সবাই দেখে ফেলেছে সেই ছবি, যেখানে একটা কালো বৃত্তাকার অংশকে ঘিরে উজ্জ্বল কমলা/হলদে বলয় দেখা যাচ্ছে। ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্র যেমন দেখতে হওয়ার কথা বলা হয়েছিলো, অর্থাৎ আলো যেখান থেকে ফেরত আসেনা সেই জায়গা যেমন হওয়ার কথা সেরকমই দেখতে। পদার্থবিজ্ঞানে যারা আদর্শ কৃষ্ণবস্তু সম্পর্কে পড়েছে তাদের মনে থাকতে পারে, সেখানেও একই ঘটনা ঘটছিল। ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রের অন্ধকারময় অংশ যেখান শেষ হয়ে প্রথম আলোর বৃত্ত শুরু হয়, সেই সীমারেখার নাম ইভেন্ট হরাইজন। ইভেন্ট হরাইজন গোলাকার। অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরের সাথে অন্যান্য অপেক্ষাকৃত ছোট কৃষ্ণগহ্বরের তফাৎ হলো, অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরের আয়তন খুবই বেশি, ফলে ঘনত্ব বেশ কম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা জলের থেকেও কম ঘনত্ববিশিষ্ট হতে পারে।

যে ছবি নিয়ে বিশ্ব তোলপাড়, তা একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের। ৫৫ মিলিয়ন (৫৫০ লক্ষ) আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরের সূর্যের থেকে সাড়ে ছয় বিলিয়ন গুণ ভারি। আমরা আগেই জেনেছি অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর ছায়াপথের কেন্দ্রে থাকে। আলোচ্য অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরটি মেসিয়র ৮৭ বা M87 নামের জান্তব ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত। সহজেই বোঝা যাচ্ছে, এতদূর থেকে আলো পর্যন্ত মুক্তি পায় না এমন বস্তুর ছবি তোলা, তাও খুব উচ্চমানের ছবি যাতে কৃষ্ণগহ্বরের বিভিন্ন অংশ চিহ্নিত করা যাবে— এজন্য বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপ দরকার ছিল। ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপই সেই যন্ত্র, বা যন্ত্রসমষ্টি। এমন নামের কারণ, এই টেলিস্কোপের রিজোলিউশন ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হরাইজনের সমতুল্য। গোটা পৃথিবী জুড়ে আক্ষরিক অর্থেই ‘বিছিয়ে’ রাখা হলো আটটি টেলিস্কোপ, যা একে আরেকটির থেকে বেশ খানিকটা দূরে দূরে অবস্থিত। এর ফলে যে টেলিস্কোপ-সমষ্টি তৈরি হলো তা আক্ষরিক অর্থে পৃথিবীর সমাজ আকারের না হলেও কার্যকারিতায় সেরকমই অবিশ্বাস্য আকারের একটি টেলিস্কোপের সাথে তুলনীয়। অঙ্ক কষে আগেই দেখা গেছিল, এই আকারের টেলিস্কোপই প্রয়োজনীয় রিজোলিউশন দিতে পারে। এরপর শুরু হলো ডেটা নেয়া। বলা হচ্ছে কদিন আগের বহু আলোচ্য এল এইচ সি এক্সপেরিমেন্টে এক বছরে সংগৃহীত তথ্যের সমান তথ্য দু সপ্তাহেই জমে উঠেছে। সব মিলিয়ে কয়েক পিটাবাইট তথ্য (১০০০ টেরাবাইটে এক পিটাবাইট)। এই বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ করতে সময় লেগেছে অনেক। আটটি টেলিস্কোপের নেওয়া অসংখ্য ছবি আসলে মূল ছবির এক একটি টুকরো। এরপরের কাজ ছিলো সেই টুকরোগুলো থেকে কৃষ্ণগহ্বরের ছবি রিকনস্ট্রাক্ট করা। ২০১৭ সালের একটি বক্তৃতায় এম আই টির গবেষক কেটি বাওম্যান কীভাবে অজস্র টুকরো ছবি জুড়ে মূল রূপে পৌঁছনো যায় তা ব্যাখ্যা করেন। কেটি যে কম্পিউটার অ্যালগোরিদম নিয়ে কাজ করছিলেন তা সরাসরি ২০১৯ সালের তথ্য বিশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু যে তিনটি আলাদা বিজ্ঞানীদলের সম্মিলিত কাজের ফল ১০ এপ্রিলের ছবি, তার মধ্যে কেটিও ছিলেন। এম৮৭ ছাড়াও মিল্কি ওয়ের কেন্দ্রের অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরের ছবিও তোলা হয়েছে, যা এখনও বিশ্লেষণের অপেক্ষায়।