মাহমুদুল হক

মাহমুদুল হক

কোথাও কোনো দাগ লেগে নেই!

এমদাদ রহমান

প্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০২০

প্যারিসে, ক্রমশ গভীর হচ্ছে রাত; বুলভার ম্যাক্সিম গোর্কি নিঃস্তব্ধ। জানালা খুলে দিতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কী এক ভয়... হলদে আলোয় দেখি সিগ্ন্যাল বাতিগুলো সবুজ থেকে ক্রমশ লাল হয়ে এলো, কিন্তু একটিও গাড়ি নেই। থেমে থেমে আত্মা খামচে ধরে দ্রুতগামী অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। আশা তবু... রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ল। বন্ধ জানলায় মাথা ঠেকিয়ে মনে মনে গাইলামও দু-এক লাইন:

কোন্‌ খেলা যে খেলব কখন্‌ ভাবি বসে সেই কথাটাই
তোমার আপন খেলার সাথি করো
তা হলে আর ভাবনা তো নাই

শিশির-ভেজা সকালবেলা আজ কি তোমার ছুটির খেলা
বর্ষণহীন মেঘের মেলা তার সনে মোর মনকে ভাসাই

এই রাতেই পড়ছিলাম মাহমুদুল হককে, `কালো বরফ`। কলেজ শিক্ষক আবদুল খালেক, কোনও এক ভরদুপুরে, বহু বছর পর তার মায়ের গাওয়া গানের কলি `ও আমার কোলে এলো` নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। মাহমুদুল হক লেখেন, আজ, এই ভরদুপুরে, গরিব বৌনাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে, এক অস্থির আবদুল খালেক, রেখা যাকে তার স্বামী বলে জানে, টুকু যাকে তার আব্বা বলে চেনে, হু হু করে কেঁদে ফেলল। এতদিন পর, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে, ঝিরঝির বিপর্যয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো, গানের ওই কলিতে ভরদুপুরেও আকাশে চাঁদ ওঠে, সব রোগের নিরাময় ঘটে, সব পাপ ধুয়ে যায়, জগৎ-সংসার ভেসে যায়। কেবলই মনে হয়, কৈ, কোথাও তো কোনো দাগ লেগে নেই!

`কালো বরফ` পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, আহারে, জীবনের আশ্চর্য সব সকাল দুপুর বিকেল আমরা বোকার মতো হারিয়ে ফেলেছি! এখন আবার খোঁজ করছি নতুন করে, সেইসব, সেইসব— `যা কিছু নিঃশব্দ, যা কিছু শব্দময়, যা কিছু দৃশ্যগোচর, দৃশ্যাতীত, সবকিছু একজোট হয়ে হাত ধরাধরি করে ঘিরে ধরে; অদ্ভুত এক বাজনার তালে তালে আস্ত একটি রাত মোমের মতো গলে পড়ে...`

মাহমুদুল হক থেকে চলে গিয়েছিলাম পামুকের কাছে। ওরহান পামুক। প্যারিস থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল তখন। অবিরাম ঘরে থাকতে থাকতে ছটফট করছিলাম। ইস্তানবুল যেতে ইচ্ছে করছিল। এরকম দিন আর কখনও আসেনি, যখন নিজের হাতকেও ভয় করে; বারবার স্যানিটাইজার দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হয়, আঙুলগুলো যখন কীবোর্ড বিলি কাটে, শব্দের পর শব্দ লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

পামুক কিছুটা রিলিফ দিলেন। দেখলাম জীবনের পাতাগুলো ফের সবুজ হয়ে উঠছে। `নৈঃশব্দ্যের সংলাপ` থেকে পড়লাম, তার সাক্ষাৎকারের অল্পকিছু।

সাক্ষাৎকারী, ওরহান পামুককে, আপনার ভেতরের সেই চিত্রকর কীভাবে লেখার প্রেরণা দেয়?
পামুক: যে আমি লেখক হয়ে ‘ইস্তানবুল’ নামক স্মৃতিকথা এবং ‘দ্য ইনোসেন্স অব অবজেক্টস’ বইটি লিখেছি, সেই আমিই তো একদিন চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলাম! ২৩ বছর বয়সে মাথার ভেতরের একটি রহস্যময় প্যাঁচ শিথিল হয়ে গিয়েছিল, তখন ছবি আঁকবার চিন্তা বাদ দিয়ে রাতের ইস্তানবুল দেখতে দেখতে ঘরে এসেই উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু রঙের কাজ আমি এখনও ছাড়িনি। ছাড়তে পারিনি। যখন কিছু আঁকতে যাই নিজেকে তখনই খুব সুখী ভাবতে পারি। কিন্তু এই অনুভবটিও আমাকে বিস্মিত করে। যখন লিখতে বসি তখন আমি যেন পুরো পৃথিবীর সঙ্গে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি! হ্যাঁ, চিত্রকলা আর সাহিত্য হচ্ছে শিল্পের দুই বোন। কলাম্বিয়ায় ছাত্রদেরও এই কথাটা বলেছিলাম। ছাত্রদেরকে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা নিয়ে ভাবতে বলতাম। তারপর তাদের জিজ্ঞেস করতাম, ভাবনাটি কোনো বিশেষ শব্দ কিংবা ছবির সঙ্গে সম্পর্কিত কি না। তাদের উত্তর ছিল, দুটোই! উপন্যাস আমাদের কাছে মৌখিক (দস্তইয়েভস্কি) এবং দৃষ্টিনির্ভর (প্রুস্ত, নবোকভ) কল্পনাশক্তিকে বিশিষ্ট করে তুলে ধরে। দস্তইয়েভস্কি-র উপন্যাসগুলোয় বহু অবিস্মরণীয় দৃশ্য আছে, হ্যাঁ, দৃশ্যগুলোকে হয়তো ভুলে যাওয়া অসম্ভব কিন্তু সেসব দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ড, ল্যান্ডস্কেপ কিংবা অবজেক্ট-কে আমরা খুব কমই মনে রাখার চেষ্টা করি।

এমন কয়েকজন ঔপন্যাসিক আছেন যারা স্মরণীয় দৃশ্যগুলো গড়ে তোলেন আমাদের মনের ভেতরে নানারকমের ছবি তৈরি করে। ফ্লবেয়ার কথিত সেই ‘পারফেক্ট ওয়ার্ল্ড’ গড়ে উঠবার পূর্বে, লেখকের কল্পনায় সম্পূর্ণ নিখুঁত ছবিগুলো থাকতে হয়। একজন পাঠক মাঝে মাঝেই তার পড়তে থাকা উপন্যাসটি বন্ধ করে ওপরে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, এই তাকানোর মানে হচ্ছে তিনি তখন বাক্যে বাক্যে, অনুচ্ছেদে অনুচ্ছেদে লেখক যে-ছবিগুলো এঁকেছেন, যে-দৃশ্যগুলো তৈরি করেছেন তিনি সেগুলো দেখতে পাচ্ছেন। আমরা এই পাঠকদের জন্যই তো লিখি। বছরের পর বছর ধরে, আমার ভেতরে নিত্য বিরাজমান সেই চিত্রকর ‘লেখক’ হিসেবে আমাকে এই পাঁচটি কথা শিখিয়েছে—

১. লিখতে বসার আগে পুরো লেখার পূর্ণাঙ্গ একটি ধারণা না নিয়ে লেখাটি শুরু করবে না, তা না হলে তুমি লিখে ফেলবে একটি লিরিক্যাল টেক্সট কিংবা কবিতা।

২. পরিপূর্ণ শুদ্ধতা ও নিখুঁত সামঞ্জস্যের সন্ধান করবে না—এই বিষয়গুলো কাজের প্রাণকে হত্যা করে।

৩. যে-দৃষ্টিকোণ থেকে লিখতে চাও তার পরিপ্রেক্ষিত, বিষয়বস্তুর গভীরতা, দৈর্ঘ্য, অবস্থান ইতাদির নিয়মকে অগ্রাহ্য করো না, চরিত্রের চোখ দিয়ে বিশ্বটাকে দ্যাখো।

৪. ভ্যান গগ কিংবা নিও-এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের মতো তুমিও তুলির চমৎকারিত্ব দেখাও যাতে পাঠক তোমার উপন্যাসের লিখনশৈলীকে পছন্দ করে যে-কোনো জায়গা থেকে।

৫. লেখায় আকস্মিক সৌন্দর্যকে শনাক্ত করার চেষ্টা করবে, যে আকস্মিকতার জন্য তোমার না কোনো ধারণা ছিল, না ছিল অভিপ্রায়।

আমার ভেতরের সেই চিত্রকর আর সেই লেখকের মধ্যে প্রতিদিনই বন্ধুত্ব হয় আর সে কারণেই আমি এখনও বিভিন্ন রকমের ছবি ও ছবির বইয়ের সঙ্গে টেক্সট আর স্টোরিকে একাকার করে উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করি।