করোনা ভাইরাস আর বন্ধুত্বের হাত
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : মার্চ ২৯, ২০২০
করোনা ভাইরাসের সঙ্কটকে ঘিরে ক’দিন ধরে ঘরে বসে আছি। বাসার রান্নার মানুষটি গ্রামে চলে গেছে। নিজেকেই বলতে গেলে রান্না করতে হয়। লেখালেখি-গবেষণা প্রায় বন্ধ। সবরকম আড্ডাও বন্ধ। যদিও গুলশানে হাবিব ভাইর বাসায় নাস্তার আড্ডা ‘দরবার এ হাবিব’ এখন পর্যন্ত খোলা আছে। কিন্তু যাওয়া হচ্ছে না। কথা ছিল, হাবিব ভাই গ্রামে যাবেন তিন দিনের জন্য। আজ জানলাম, তিনি গ্রামে যাননি। তার বাসায় নিয়মিত নাস্তার আড্ডা হচ্ছে। কাছকাছি যারা থাকেন, কেউ কেউ আসছেন গৃহবন্দি জীবনে কিছুটা সময় কাটাতে।
বিজয়নগর থেকে গুলশান অনেক দূরে। আমার জন্য যাওয়া ততটা সুবিধাজনক নয়। আর আমি এসময়ে ঘরেই থাকতে চাই। বিকেলে রমনা উদ্যানে হাঁটতে যেতাম। চারদিন নানা কারণে সেটাও বন্ধ। ভাগ্যিস, হাঁটতে বের হই ন। প্রশাসনের যে রূপ দেখতে পাচ্ছি, বুড়ো বয়সে কান ধরতে ভালো লাগতো না। কতেক্ষণ ঘরে বসে থাকা যায়! বাইরের নানা দুর্যোগপূর্ণ খবর শুনে পড়াশুনায় মনোযোগ দিতে পারছি না। হঠাৎ দুপুরবেলা একটা ফোন এলো।
ঝুনা চৌধুরী ফোন করেছেন। ফোন ধরার সঙ্গেই সরাসরি প্রশ্ন করলেন, বাসায় কী করছেন?
সংক্ষিপ্তভাবে সব কিছু, আমার বর্তমান অবস্থার কথা তাকে বললাম। ঝুনা বললেন, চলে আসেন আমার বাসায়। অন্তত আপনাকে রান্না করে খেতে হবে না।
বিস্মিত হলাম ঝুনার কথায়। আমরা অনেকদিনের ভালো বন্ধু। পারিবারিক বন্ধু হয়ে গেছি বহুদিন থেকেই। তারপরেও যখন সবাই ভীত অন্যের দ্বারা সংক্রামিত হবার, স্বামী-স্ত্রী বহু ক্ষেত্রে দূরত্ব বজায় রাখছে, তখন ঝুনা আমাকে বুক ফুলিয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন তার বাসায় থাকার জন্য। ব্যাপারটা খুব সহজ নয় এসময়ে। বিভিন্ন সময়ে আমি অসুস্থ হলে যেসব বন্ধুরা বলে বাসায় চলে আসে, তারাও এবার নীরব। আমি মনে করি, এটাই স্বাভাবিক আচরণ সবার জন্য। বর্তমান অবস্থাকে সামাল দিতে হলে ঠিক তাই করা দরকার।
গত পরশু আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ন্যান্সি অবশ্য ফোন করে খবর নিয়েছে আমার। সতর্ক থাকার নানা পরামর্শ দিয়েছে। বললো, তুমি একা আছে বলে আগে তোমার খোঁজ নিলাম। নানারকম কথা হলো। সবশেষে অবশ্য বললো, যেকোনো সমস্যা বা সঙ্কটে যেন ফোন করি। কথাটা জোর দিয়ে কয়েকবার বললো যেন সঙ্কটে ফোন দিতে দ্বিধা না করি। বাজারে বহু কিছু পাওয়া যাচ্ছে না, তাই আকারে-ইঙ্গিতে বললো, খাবার-দাবারের বা কোনো সামগ্রির সঙ্কট হলেও যেন জানাই। ন্যান্সির ফোন পেয়ে অন্য সময়ের চেয়ে সেদিন বেশি ভালো লেগেছিল। ন্যান্সি স্বামীকে নিয়ে বসুন্ধরায় চার বেড রুমের বাড়িতে থাকে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে কয়েক বছর। যখন চিকনগুনিয়া হয়েছিল, বলেছিল ওর বাসায় চলে যেতে। এবার সরাসরি তা বললো না। করোনা সবাইকে অনেকটা অসহায় করে তুলেছে।
ঝুনার ফোন পেয়ে মনটা সত্যিই বেশ ভালো হলো। ঝুনার বাসায় চলে যাবে, সেজন্য নয়। কিছুই না, এই যে এরকম দুর্যোগে বলতে পারা বাসায় চলে আসেন। সামান্য পরে বললেন, আজকেই চলে আসেন। একা একা কষ্ট করবেন কেন? বুঝলাম, ঝুনার ফোন করার লক্ষ্য আমাকে এখানে একা থাকতে না দেয়া। প্রাপ্তির বিয়ে হয়ে যাবার পরও কিন্তু বাসায় ওর এক কন্যা আর এক মেয়ে রয়েছে। যদি আমি তার বাসায় যাই, স্বভাবতই তা নিয়ে সংক্রামিত হবার ভয়ে দুশ্চিন্তা করার কথা। কিন্তু তা একেবারেই করছে মনে হলো না। বরং লুনা পর্যন্ত যেতে বললো। ঝুনা আমার সব অসুস্থতার সময় আমাকে তার বাসায় চলে যেতে বলেন। চিকনগুনিয়ার সময় তিনদিন তার বাসায় থাকতে হয়েছে ঈদের সময়। বাচ্চাগুলি সংক্রামিত হতে পারে ভেবে পরে জোর করে বাসায় চলে এসেছিলাম। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা তো আরও আলাদা। আরও ভয়াবহ। ঝুনাকে নিশ্চিত করে কিছু বলিনি, বাসায় রয়ে গেছি।
ঢাকায় বহু বন্ধু ও পরিচিতরা রয়েছেন। সম্ভবত তারা এখন বাসায় থাকতে দেয়ার আগ্রহ দেখানো দূরের কথা, সংক্রামণ এড়াবার জন্য অনেকে চা খেতেও বাসায় ডাকবেন না। এটা কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়, এটাই স্বাভাবিক আর বাস্তব। করোনা আমাদের সেখানে নিয়ে গেছে। সবার মনোভাবই প্রায় সেরকম। করোনা ভাইরাস সমাজের বহু কিছুর গুণগত অবস্থা পাল্টে দিয়েছে। কিন্তু ঝুনার আন্তরিক আমন্ত্রণ আমার মনের ভিতরে কিছু একটা সংক্রামিত করে গেল। মনে হলো, ঝুনার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আগের মতো আছে। করোনা কিছু পাল্টাতে পারেনি! ঝুনার সঙ্গে আমার গত দুমাসের বেশি দেখা নেই। ফোনেও কথা হয়নি তেমন। কিন্তু আমি জানি, এরকম সময় ঝুনা চৌধুরী ঠিক আমার খোঁজ নেবেন। তাই হলো। কিন্তু বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়ে বসবেন, ধারণা ছিল না। মানুষ নিয়মের মধ্যে নিয়ম পাল্টাতে পারে।
মানুষ আসলে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়। যখন পারে না, সেটা তার অসহায়ত্ব। সমাজ ব্যবস্থা, চারপাশের ঘটনা, আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও নানা দুর্যোগ— মানুষকে নানাভাবে অসহায় করে রাখে। কিন্তু তার ভেতর দিয়ে নানারকম উপকার করার মানুষের দেখা মেলে। নেত্রোকোণার সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত একজনের সঙ্গে আমার বছর দুই আগে পরিচয়। পড়াশুনা ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে বলতে ঘনিষ্ঠতা মাস দুয়েক হলো। ঘনিষ্ঠতা মানে ফোনে আলাপ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, তার মধ্যে রাজনীতি বেশি। যদিও তার রাজনৈতিক চিন্তা আর আমার চিন্তা যথেষ্ট আলাদা। কারণ আমি সরকারের দল বা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না। তিনি রাজনীতি করেন, কিন্তু কখনো উগ্রভাবে কথা বলেন না। সম্পর্ক সুন্দর রাখতে পারস্পরিক সম্মানটা বড় কথা। ঢাকায় থাকে সে স্বামীর সঙ্গে। করোনা ভাইরাসের সঙ্কটে হঠাৎ ঠিক করলো দশদিনের জন্য সবাই নেত্রোকোণায় চলে যাবে বাবার বাড়িতে। যাবার আগে যখন টেলিফোনে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলো আমায় রান্নায় সাহায্য করবার কেউ থাকছে না, সরাসরি সে আমাকে তার সঙ্গে তার বাড়ি যাবার প্রস্তাব দিয়ে ফেললো।
তার স্বামীর সঙ্গে আমার আলাপ ফোনে। তার বাবা-মা কারো সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। সরকারের আমি সমালোচনা করি, তাও জানে। কিন্তু খুব জোর করলো আমাকে তার বাবার বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য। বললো, যতদিন সঙ্কট না কমছে থাকবেন আমাদের বাড়িতে। পড়াশুনা করবেন, লেখালেখি করবেন।
নিশ্চয়ই এমন ঘটনা বারবার ঘটে। ঘটনাগুলি নাটকীয় কিন্তু ঘটে। সহযোগিতার হাত বাড়াবার ইচ্ছা মানুষের হয়। না হলে করোনা ভাইরাসের আক্রমণে চিকিৎসকরা হঠাৎ কেন ঝুঁকি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছেন। যখন আত্মীয় বন্ধুরা দূরে সরে থাকছে বাস্তবতার কারণে, চিকিৎসক তখন আপন হয়ে উঠছেন। চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীরা পরম আত্মীয় হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। বণিকতন্ত্র টিকে আছে, টিকে থাকবে আরও অনেকদিন। কিন্তু করোনা ভাইরাসের আক্রমণে বণিকতন্ত্রকে ছাপিয়ে বহু মানুষের মন কেঁদে উঠছে। মানুষের মন বিচিত্র, নানা ঘটনায় একই মানুষ নানাভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। প্রতিটা মানুষের মধ্যে আরও হাজারটা মানুষ বাস করে। যদিও সবকিছুর পিছনে কার্যকারণ থাকে, চট করে তার ব্যাখ্যা করা কঠিন। মানুষের স্বভাব, মানুষের প্রকৃতি অনড় নয়। বিভিন্ন রকম রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, বিভিন্ন রকম মানুষের সংস্পর্শে একই মানুষ ভিন্ন ভিন্নভাবে নিজের চরিত্রসৃষ্টি করে চলে। না-হলে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, মহাকাব্য লেখা হতো না।