`খাঁচা` যেন ধূসর শালপাতায় জড়ানো নির্মাতার হৃৎপিণ্ড

হাবিবুর রহমান

প্রকাশিত : এপ্রিল ২১, ২০১৯

কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের গল্প অবলম্বনে আকরাম খান নির্মিত ‘খাঁচা’ যুগ প্রবর্তক সিনেমা। যুগ প্রবর্তক কারণ, তার নান্দনিকতা, সমাজসচেতনতা এবং সত্যনিষ্ঠতা। সমকালীন এবং সমসাময়িক যে কোনো সিনেমার তুলনায় ‘খাঁচা’ আধুনিক। স্থূল বোধ-বুদ্ধিহীন সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বাতাবরণ আমাদের ভিতরটাকে ক্ষয় করে ফেলছে। একটা সিনেমায় সেই ক্ষত পূরণ সম্ভব নয়। `খাঁচা` সমাজের এই অসুখকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করেছে।

দেশভাগ পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষাপটে একটি হিন্দু পরিবার ভিটামাটি ছেড়ে ভারতে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সে ইচ্ছা পূরণ হয় না। নিজ বাসভূমে পরবাসীর জীবন জানে, ওপারে গিয়েও যে তাদের দুর্দশার কাল শেষ হবে না। সামাজিক টানাপোড়েন, আর্থিক অনটন মিলিয়ে যেন খাঁচাবন্দি কিছু প্রাণ। যদিও শিল্প স্থির নয়, তা নিরবধি বয়ে চলে। তা আজকের লোকে দেখুক বা না দেখুক, যে যাই বলুক, নিমাই ঘোষের `ছিন্নমূল` একটা নতুন যুগের প্রবর্তন করেছিল। যদিও সেই সময়ের প্রতিকূলতার সাথে আজকের তুলনাই চলে না। তবু সারি পাঁচিল পাড়ি দিয়ে `খাঁচা`র মতো একটা সিনেমা দর্শকের অক্ষি-কর্ণের সামনে নিবেদিত হয়।

দেশভাগের কারণে হঠাৎ চিরচেনা জীবন কেমন যেন বদলে যাচ্ছে! আর ওপারে পাড়ি দেয়ার স্বপ্নের ভেতর যেমন সময় এগিয়ে যায় ঠিক তেমনি ফেলে আশা রঙিন দিনগুলোও পিছু টানে, দীর্ঘশ্বাসে ভারাক্রান্ত করে। যে পুরাণ পিতামহের জন্য এখনো যাপিত জীবন সেই পুরাণ দৌহিত্রের জন্য শুধু গালগল্প। পিতামহের দৃষ্টিতে যে পূজনীয় তক্ষক ঘরের `লক্ষ্মী’ হয়ে আসে তাকে হত্যা করার জন্য দৌহিত্র ফুঁসে ওঠে। বাড়ি বদলের স্বপ্ন বারবার মরীচিকায় মিলিয়ে যায়। যে সেতার বহু বছর নিশ্চুপ, নিথর হয়ে ছিল সেটা হীরেনের হাতে ঝংকার দিয়ে ওঠে। কিন্তু এই ঝংকার সরোজিনীকে স্পর্শ করে না। বরং সে রাগে-রোষে অগ্নিমূর্তিতে রূপান্তরিত হয়।

অবধারিত মৃত্যুভয়ে আক্রান্ত অম্বুজাক্ষের মুখটা এই সিনেমার শেষ দৃশ্য। জীবন চলচ্চিত্র নয়। এখানে আগে থেকে ঠিক করা কোনো চিত্রনাট্য থাকে না। মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেষ্টাতে সামগ্রিক সকল অর্জন। আর মানবিকতা মানে এক প্রজন্মের মানুষের সাথে অন্য প্রজন্মের সম্পর্ক। যেসব সিনেমা দেখলে এই অনুভূতি আপনি পাবেন, যেমন ইয়সিজুরো ওজুর টোকিও স্টোরি, ‘খাঁচা’ তেমন সিনেমা। মধুপুরে দেখেছিলাম, ধূসর শালপাতায় জড়িয়ে হরিণের গোশত বিক্রি করা হয়। `খাঁচা` সিনেমাটি দেখে আমার একই অনুভূতি হয়েছিল। `খাঁচা` যেন একটা ধূসর শালপাতায় জড়ানো নির্মাতার হৃৎপিণ্ড।