খাদিজাতুল কোবরার আত্মগদ্য ‘মৃত্যু আর নৈঃশব্দ্যের চিৎকার’

প্রকাশিত : মার্চ ২০, ২০২০

বিজয় সরণিতে এলেই গা ছমছম করে। চন্দ্রিমা, আগারগাঁও মোড়ে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। বাসা থেকে হেঁটে অফিস যেতে আমার সোয়া এক ঘণ্টা লাগে। টানা হাঁটতে পারি না, ইদানীং খুব কষ্ট হয়। গণভবনের যেখানে শেষ, ঠিক উল্টোদিকে আওরঙ্গজেব রোড। রাস্তার মোরে রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুলের বড় রেইনট্রির অর্ধেকগাছ ছাতার মতো এই জাগাকে আলাদা করেছে। এইখানে জিরিয়ে নিতে ভাল্লাগে আমার। দম পাই। যাতে পরে চন্দ্রিমা ধরে ওই পুরো রাস্তা এক নিশ্বাসে পার হতে পারি। আর গণভবনে এখন যেহেতু কেউ থাকে না, পুরো পথ খুব অচেনা লাগে। এটুকু পথে হাঁটার গতি আমার এমনিতেই বেড়ে যায়। চারদিক শ্মশানের চেয়েও নীরব। মনে হয়, পেছন থেকে কেউ যেন ডাক দেয়। কেউ যেন কানের কাছে ফিসফিস করে যায়। সে সময় মনে হয়, পাগুলো কে যেন রাস্তায় আটকে আটকে ধরে রাখছে। আমি আরো জোরে পা টেনে টেনে হাঁটতে থাকি।

লেকের পানি শুকিয়ে গেছে। কত কড়াকড়ির মধ্যেও লোকে এইখানে আসতো। হালকা সন্ধ্যা হলেই জ্বলে উঠতো রাধা-কৃষ্ণরা। কিন্তু এখন মনে হয়, শত বছর পুরোনো কোনো লোকালয়ে হেঁটে চলছি। দুই মাস আগেও এখানে মানুষ আসতো, তা মনে হয় না। খেঁজুর বাগান মোড় আসতে আসতেই আমি ঘেমে ভিজে যাই। আমার জুতাও পিচ্ছিল হতে শুরু করে। বিজয় সরণি মোড়ে আর্মি ক্যাম্প। এখানে প্রতিদিন গায়ের তাপ মাপে ওরা। প্রতিদিন আসা-যাওয়ার পথে একটা পাস নিতে হয় সুস্থতার। এরপর আবার চলতে থাকি। এদের কারো মুখে কোনো কথা নেই। চোখ বড্ড করুণ, আর অচেনা। আমার ভয় লেগে যায়। আমার কান্না আসে। প্রতিদিন মৃত্যুর হিসেব করতে করতে নিজেকে এখন অফিসের যন্ত্রগুলোর মতো লাগে। বরং অফিসের সময়টুকুতেই আরাম লাগে। এত মৃত্যু আর নৈঃশব্দ্যের চিৎকারে নিজের কিছুই মনে থাকে না।

অফিসের থার্মাল স্কেনারের কাছে কেউ নাই। গার্ডের দিকে তাকালাম। নির্বিকার। এমনি এমনি পার হয়ে গেলাম। কেউ কিছু বলছে না। সবাই কেমন স্তব্ধ। ডেস্কের পিসির কীবোর্ড টেবিল মুছলাম। সব ডেস্ক এক থেকে দুজন লোক। তবু যেন আজ আলাদা কিছু। ওপাশ থেকে হাত ইশারায় ডাকলো মাহা। দূরত্ব রেখে কাছে গেলাম। বললো, আজ থার্মাল ম্যান চাটাই। আমি বললাম মানে? মাহা বললো, হুমম, সকালে মাথা ঘুরে পড়ে যায়, বমি করছে, জ্বরও ছিল। আমি বললাম, তার মানে অফিসের সবাইকে কোয়ারান্টাইনে যেতে হবে। মাহা বলল, এখনই না, রিপোর্ট হাতে পেলে তবে।

আমার মাথা ঘুরছিল। বাসায় চাল নাই দুদিন। সবাই চিড়া আর বিস্কিট খেয়ে আছে। বাচ্চার দুধ শেষের দিকে। আমার চোখ ঘোলা হয়ে আসছে। ড্যাশ বোর্ডের  লিংক ওপেন করা লাল রঙের দুটা লাইন ব্লিংক করছে। রাঙামাটিতে পাঁচ জনের মৃত্যু... মাউস ধরে বসে আছি। লেফট বাটন ক্লিক করতে ইচ্ছে করছে না। জানতে ইচ্ছে করছে না কারা এরা। কোথায় মরে আছে। কখন ঘটল এই মৃত্যু... পাশ থেকে একজন চিৎকার করছে... এই কয় জন মরছে, দ্যাখো দ্যাখো, জলদি ব্রেকিং দাও... অফিসের সারাটাক্ষণ আমার বুক কাঁপছে সকালের ঘটনা নিয়ে। আমার সাত মাসের বাচ্চাটা, আমার মা! এই তিনজন। আমার যেতে হলে, অভিপ্রিয়কে নিয়ে মা ক্যামনে থাকবে! কিংবা ওদেরও কি যেতে হবে? কে কোথায় থাকবে! মা এই শহরের কিছু চেনে না। আর এই সময়তো সে বাসাতেই আতংকে থাকে। শ্বাসকষ্ট লাগছে আমার। গলাও বন্ধ  হয়ে আসছে। খোলা জায়গায় যেতে ইচ্ছে করছে।

সন্ধ্যা সাতটা। অফিস থেকে কেউ বের হয়নি। পাশের ডেস্কের শাওন কাঁদছে। আমরা বসে আছি একটা রিপোর্টের অপেক্ষায়। এরপর কোথায় যাব আমরা, মেইল করা হবে আমাদের। হঠাৎ আমার মনে হলো, পালাই। এক দৌড়ে যদি বাসায় যেতে পারতাম, ওখান থেকে খুব দ্রুত মা আর অভিকে নিয়ে... কিন্তু কোথায় কিভাবে... সব বন্ধ। কোথাও কিচ্ছু নেই। আমরা আমাদের কাছে বন্দি হয়ে আছি। এর শেষ কোথায়, জানি না। শুধু ওই মেইল চেক করেই বলতে পারবো, কোথায় যাব আমরা...

 

২০.৩.২০২০

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী