চিত্রকর্ম: সালভাদর দালি

চিত্রকর্ম: সালভাদর দালি

ঘড়ির দোকান থেকে বেরিয়ে আরো একবার সময়কে চিনলাম

সাঈফ ইবনে রফিক

প্রকাশিত : আগস্ট ১২, ২০১৯

ঘড়ির দোকানে অসংখ্য সময় ঝুলে থাকে দেয়ালে দেয়ালে। প্রতিটি সময় সত্য। কেবল স্থানভেদে ওরা মিথ্যে হয়ে গেছে। ফটোসান চোখে প্রখর রোদকে মেঘলা মনে হয়। কেবল ঘাড় ঘুরালেই আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে না, পাছে লোকে আপনাকে ঘাড় ত্যাড়া বলবে। অপ্রতিষ্ঠান আপনাকে আত্মবিশ্বাস দিয়ে প্রতারিত করে। আত্মবিশ্বাসে ভর করে আপনি সবাইকে পাগল ভাববেন, আর বাকি সবাই আপনাকে। স্রোতের বিরুদ্ধে ক্ষণস্থায়ী পাল্টা স্রোত। ক্ষণজন্মা প্রতিভা। নিজেকে নিরপেক্ষ চেনার প্রতিভা আজ বিরল। আজকাল নিজেকে চেনা হয় বাড়তি অনুমানে। আপনিও নানা প্রসেসিঙে কবিতা ছাপাচ্ছেন আর জীবনানন্দের কাব্য মার্কেটিংয়ে মিলিয়ে দেখছেন। লিপিস্টিকে হাঁটছেন প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায়। কেউবা ভেঙে পড়ছেন নির্বাচনী ঢঙে সাহিত্যগর্ভ যুদ্ধক্ষেত্রে।

জীবনানন্দীয় সময়চেতনার আঙ্গিকেও পরিবর্তন এসেছে। বি ফিফটি-টু নাপাম রুইয়ে গিয়েছিল ভিয়েতনামের শস্যক্ষেত্রে। অস্ত্রধারীই চিরকাল সবাইকে নিরস্ত্র হতে বলে। ইতিহাসের কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে গেছে শত শত প্লান কমিশন— আমাদের টুইন টাওয়ারও যাবে। সময়ের ফরমালিনে ডুবে থাকে মহাকাল। আট বছর আগের লাশকাটা ঘর প্রতি তারিখেই, প্রতিদিনই নবায়ন হচ্ছে। নিবন্ধিত হচ্ছে মহাকালে। এ সময়ে সে কবিতাকে ছুঁড়ে দিতে হচ্ছে বরফ যুগেরও ওপারে অন্য কোনো সভ্যতায়, অন্য কোনো ইতিহাসে, অন্য কোনো মহাকালে। সময় ও স্থানের বিচ্যুতি যেখানে এক হয়ে আছে। এ সময়ে প্রতিটি স্থানে প্রতিটি সময় একসাথে সত্য ভাবতে হবে কবিকে। আশ্বাসবাণী আপনাকে অনেক বিরক্ত করবে। আসক্ত করবে উদ্দেশ্যহীনতায়। সাহিত্যফ্যাশন হতাশাগ্রস্ত নেশাকে কিছুটা বৈধতা দেয় বোধহয়। উদ্দেশ্যহীনতা দায়মুক্তি খোঁজে। দায়হীন কবিতা সংগ্রহের দায় মহাকালের বর্তায় না। কবির যোগ্যতা একটা বহু বিতর্কের প্রশ্ন। সময়জ্ঞান বুঝতে কাণ্ডজ্ঞান লাগে। টিপিকাল সমাজে ওঠার আকুতি। বারবার পা পিছলে ব্যর্থ হওয়াই কবির নিয়তি। ক্রমাগত ধসের ব্যস্ত অনুপাতে কলমের উতকর্ষ বাড়ে সত্য, তবে নিখোঁজ হওয়ারও ভয় আছে। স্বপ্নদৃশ্যেও দূরপাল্লার ক্রমবর্ধমান পরিণতি। তবু ভাবি, মঙ্গলে সফল ল্যান্ডিঙে একটুও কি তেতো হয়েছে মঙ্গলকাব্যের স্বাদ? বিরোধী সত্তায় ঝড় তোলে হাইব্রিড বিপণন। একটু পিছিয়ে যেতে চায় কবি; দূর অতীতের ভাবনাকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন সুদূর অতীতে। ইতিহাস গড়েছেন কবি। চিনে নিচ্ছেন ইতিহাস।

থেমে থাকা ঘড়িও দিনে দুই বার সঠিক সময় দেয়। কিন্তু সচল ঘড়িতে কি সত্য সময় থাকে? ঘড়ি থামে। দেহঘড়িও। চিন্তা থেকে যায় পরম্পরায়। দিন-রাত আজও থামেনি। চিরন্তনতার ছাড়পত্রে ছাড়া পায় কার্য, কার্যক্রম। ছাড়া পায় বোধ, বোধোত্তর কবিতা। লোকারণ্যে বুকস্টলে মিডিওকার কবিতাসমৃদ্ধ সাহিত্যপাতারা পরজন্মে ঝালমুড়ি, ঠোঙা হয়ে গেছে। কবিতার দায়িত্ব অন্যখানে। চিন্তায় সম্প্রসারণে। প্রমাণ সময়ের টানে সংকুচিত স্থানগুলো মুক্তি পেতে চায়। স্বাধীনতাকামী গেরিলাযুদ্ধ প্রচারমাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদী। আরো দূরে বিদ্যুতবিচ্ছিন্ন গ্রামে আধুনিকতা এসেছিলো বাংলা সাহিত্যে। হৃদয় ও মস্তিষ্কের ভারসাম্যের দিকে ছুটছে কবিতা। এ গতি ঋণাত্মক। সময়ও ছুটছে মস্তিষ্কের দিকে।  মাইক্রো সেকেন্ডে ভাগ করে নিচ্ছেন আয়ু।

কবিতাবিচারে আমি হৃদয়কে প্রধান্য দিলেও মস্তিষ্ককে এড়াতে পারছি না। কবিতা কি বিচারযোগ্য? এই যোগ্যতার সনদই বা কে দেবে? কবিতাই! আরে, এ তো দেখছি কবিতায় ঘুরপাক খাচ্ছি আমি। আমি থেকে অন্য আমি— পক্ষান্তরে। অন্তরের যোগফল মেলায় মস্তিষ্ক। ভাষাবৈষম্য টপকে কবিতা পেইন্টিং হতে চেয়েছিল। পারেনি। ভাষাগত সীমাবদ্ধতায় ছটফট করে কত আন্তর্জাতিক কবিসত্তা। ভাষার উপরে টিকে আছে সভ্যতা ও তার সহজাত বিজ্ঞানধর্মী বিদ্যেরা। কবিতা মানবিক ভাষাভিত্তিক প্রকাশ। দৃষ্টিকোণ মানবীয় হলেও কবিতা মানবতার দায়মুক্ত। এ ধরনের হাজার উপাদানে শতমুখী কবিতার চোখ।

কবিতাপ্রসঙ্গে মতৈক্য অস্বাভাবিক। ভিন্ন মতেও কবিতা আছে। সেগুলোও সত্য হতে পারে। সন্দেহ কবিসত্তায় থাকবেই। নিশ্চয়তা কবিতার ক্ষতি করলেও বাঁচিয়ে রাখে। বিষও কবিতায় জারিত হতে পারে— যে কেউ-যে কোনো সত্তা-যে কোনো বিদ্যা। প্রাথমিক পর্বে কবিতা স্বরপ্রধান থাকলেও এখন সেখানে কেবল ভাবেরই প্রাধান্য। এখানে কাঠামো পেরুলো কবিতা। তবু কিছু টিকে থাকলো, গত আমলের যা যা এ কাঠামোতেও সচল আছে।

সময়কে স্রোতের সাথে তুলনা করেছেন অনেকেই। টাইম অ্যান্ড টাইড, স্রোত অস্থির হলেও পৃথিবীর মোট পানির পরিমাণ আধ্বংসকালে একই রয়ে যাবে। সময়ও স্থির— আপনার চোখে যতই ঘুরপাক খায় গতি। কবি হয়তো এমন কোনো সময়ে পৌঁছতে চাইছেন যেখানে দূরে ও কাছে আরো নিকটবর্তী— দূরত্ব ঘুঁচে গেলে কবি থেকে সাধক হয়ে যাবার ভয় থাকে। সাধনা নিষ্কাম— কবিতায় কাম থাকে; ক্রোধও। আরো একটু আধুনিক হয়ে যাওয়া দীর্ঘযাত্রায় টিকে থাকার কথা কবিতার। মোট সময়ের পরিমাণ নিয়ে গণিতে ও মনোবিজ্ঞানে বিরোধ আবিষ্কার করবে সভ্যতা। ধর্ম ও বিজ্ঞানকে মুখোমুখি করে নিভৃতচারী যখন সাম্প্রতিক বাট্রান্ড রাসেল— তখন হয়তো কবিতা ছুটে গেছে বিশ্বাসের কাছে। ধর্ম ও বিশ্বাস কখনো সমার্থক নয়। বিশ্বাসে যোগ্যতার সাথে সহযাত্রী প্রযুক্তি। যুক্তিতো বিশ্বাসের বেশ পুরনো সাথী এখন। দীর্ঘ ঘুমে আছে ট্যাবু ও টোটেম। হয়তো কুম্ভকর্ণের মতো জেগে উঠবে আরো একবার। কবিতার জালে সময় কখনো মরা কৈ, কখনো তাজা বোয়াল! কখনো প্রবাদপ্রতিম— কখনো চোরাবালি হৃদয়ে হারিয়ে গেছে।

ঘড়ির দোকানে সেই অসংখ্য সময় ঝুলে থাকে। যে কোনো একটি সময় সত্য ঠিক ওই স্থানের প্রেক্ষিতে যেখানে আপনি আছেন। দোকানি জানেন না কোনো সময়ের খবর!

লেখক: কবি ও গণমাধ্যমকর্মী