চঞ্চল আশরাফ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতেন

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : আগস্ট ০৯, ২০১৯

সৃজনশীল লেখকদের বিস্তর পড়তে হয়। পড়ে আবার ভুলেও যেতে হয়। পাঠটাকে পাঠিয়ে দিতে হয় স্মৃতির একেবারে গোপন তলায়। উপরতলায় রাখলে সৃজনশীল শিল্প রচনায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেমন সলিমুল্লাহ খান। বিস্তর পড়েন তিনি, কিন্তু ভুলতে পারেন না, পাঠটাকে স্মৃতির গোপন তলায় পাঠিয়ে দিতে পারেন না। সে-কারণে তার পক্ষে কখনো গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটক লেখা সম্ভব নয়। সম্ভব হতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। সবাইকে কবিতা-গল্প-উপন্যাস লিখতে হবে কেন? সলিমুল্লাহ খানদের মতো প্রখর স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন পণ্ডিতেরও তো প্রয়োজন আছে। বেশি করে প্রয়োজন আছে।

তাই বলে সবার ক্ষেত্রেই কি এক রকম? না, ব্যতিক্রমও আছেন। যেমন কবি ও কথাশিল্পী চঞ্চল আশরাফ। তিনি কত বড় কবি আর কত বড় কথাশিল্পী, তা বিচার করবেন সাহিত্যবোদ্ধাগণ। কিন্তু তার স্মৃতিশক্তি যে বিস্ময়কর, দানবীয় এবং তিনি যে পণ্ডিতজন, তা বিচারের জন্য বোদ্ধা হওয়ার দরকার পড়ে না। তার কিছু কিছু চিন্তার সঙ্গে একমত হতে পারি না। এ নিয়ে তার সঙ্গে ঝগড়াঝাটিও হয়। তবু যখন তিনি বলেন, মুগ্ধ হয়ে শুনি। তার স্মৃতিশক্তি, তার পাণ্ডিত্য দেখে বিস্মিত হই। তার মাথাটা যেন কম্পিউটারের পিসি। মাউসে ক্লিক করছেন আর একে একে বেরিয়ে আসছে পুঞ্জ পুঞ্জ স্মৃতি। কখনো কখনো মনে হয়, জীবনে তিনি যা পড়েছেন তার সবই তার স্মৃতিভাণ্ডারের উপরতলায় ভেসে বেড়ায়। কিংবা গোপন তলাতেই থাকে। তবে চাইলেই তিনি সেই গোপন তলা থেকে হুটহাট বের করে আনতে পারেন। এ তার আশ্চর্য ক্ষমতা। কিন্তু এই কারণে তার শিল্পচর্চার বিঘ্ন ঘটে না। কবিতা-গল্প বা উপন্যাসকে শিল্পের শীর্ষবিন্দুর দিকে ধাবিত করতে তাকে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় না। তিনি ব্যতিক্রম।

মাঝে মধ্যে ভাবি, চঞ্চল আশরাফ তো হতে পারতেন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কেন হলেন না? হয়তো সেই চেষ্টা কখনো করেননি। কাজ করছেন একটি লাইফ স্টাইল ম্যাগাজিনে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি চাইলে তাকে শিক্ষক হিসেবে নিতে পারে না? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কারা? সংখ্যায় কম হলেও ভালো শিক্ষক নিশ্চয়ই আছেন। কিন্তু অধিকাংশই গৎবাঁধা পণ্ডিত। ছাত্রজীবনে নিজে যা পড়েছেন ক্লাসে ছাত্রদের কাছে তা-ই উগরে দেন। নিজস্ব কোনো চিন্তা দিতে পারেন না ছাত্রদের। চঞ্চল আশরাফ পারতেন। তার নিজস্ব চিন্তা আছে, চিন্তা উৎপাদন ও বিতরণের ক্ষমতা আছে। তাকে যদি সরকারি-বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো, ছাত্ররা কতই না লাভবান হতো। কিন্তু না, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তাকে নেবে না। কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পণ্ডিতদের কদর দিতে জানে না। কীভাবে ছাত্ররা সিলেবাসের বাইরে আরো আরো জ্ঞানে ঋদ্ধ হয়ে উঠতে পারে, তা নিয়ে ভাবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ম যদি এমন হতো, দেশের বড় বড় পণ্ডিত, কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, চিত্রকররা সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে সপ্তাহে তিন/চারটি করে ক্লাস নিচ্ছেন, তবে কতই না ভালো হতো! তিনি পরীক্ষা নেবেন না, খাতা দেখবেন না, অফিসিয়াল কোনো কাজে জড়াবেন না। শুধুই বলবেন, আর ছাত্ররা মুগ্ধ হয়ে শুনবে। নিজেদের জানার ভাণ্ডারকে ভরিয়ে তুলবে। কিন্তু তা হয়তো কখনোই সম্ভব নয়। কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ‘সিস্টেম’-এর রশিতে বাঁধা। এই বাঁধনটা মুক্ত করে দেয়ার কি উপায় আছে? হয়তো নেই। মুক্ত করে দিলে দেখা যাবে কলিমউদ্দিন, রজব আলী আর গজল হোসেন নিজেকে বিশিষ্ট পণ্ডিত ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস নিচ্ছে। সেটা হবে ভয়ংকর ব্যাপার।

তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলেই পারে। ডক্টরেট ডিগ্রিধারীদের প্রাধান্য একটু কম দিয়ে চঞ্চল আশরাফের মতো পণ্ডিতদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ তারা দিতেই পারে। তাতে তাদের ছাত্ররা যেমন উপকৃত হবে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামও বাড়বে।

সমকালীন কোনো লেখকের প্রশংসা করার একটা বড় বিপদ হচ্ছে, কেউ কেউ ভাবেন, কী ব্যাপার? এত প্রশংসা করছে কেন? ধান্দাটা কী? নিশ্চয়ই কোনো ধান্দা আছে। সবিনয়ে বলি, চঞ্চল আশরাফের কাছ থেকে আমার কিছু পাওয়ার নেই। দেয়ার জন্য যে ক্ষমতা থাকতে হয়, নিরীহ প্রকৃতির মানুষ চঞ্চল আশরাফের সেই ক্ষমতাও নেই। মনে হলো, তার বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তির কথা, তার পাণ্ডিত্যের কথা কালের খাতায় টোকা থাক, তাই টুকে রাখলাম।

টুকে রাখা কথামালা
৯.৮.২০১৯