জগলুল আসাদের গদ্য ‘আমার হুমায়ূন পাঠ’

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৪, ২০১৯

যে তারুণ্য বা যৌবন হুমায়ূন পাঠ করে অথবা করেছে, তাকে আমি মিস করি। আমার শৈশব, কৈশোর হুমায়ূনময় নয়। তবে মুগ্ধতা ছিল তার `অয়োময়`, `বহুব্রীহি`, `কোথাও কেউ নেই` নাটকগুলোর প্রতি, যেমনটা প্রায় অন্য অনেকেরই আছে, ছিল। হুমায়ূনকে আমি চিনেছিলাম নাটকের মাধ্যমে। তার বই প্রথম পড়া হয় কলেজে যখন প্রথম বর্ষে পড়ি, তখন। আমার হুমায়ূন পাঠের দৌড় ‘পেন্সিলে আকা পরী’, ‘অপেক্ষা’ ও ‘মেঘ বলছে যাব যাব’ পর্যন্ত। পাঠকালীন স্মৃতিও তেমন মধুময় নয়, কেন যেন টানতো না আমায়! নিজের ভেতরে হয়তো ঘাটতি ছিল কিছু একটার; নইলে সবাইতো তখন হুমায়ূনই পড়তো!

আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে বিজ্ঞানবিষয়ক বই পড়ে। যে বয়স বুঁদ হয়ে নভেল পড়ার, সে বয়সে পড়েছি বিজ্ঞানীদের আর দার্শনিকদের জীবনী। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে থাকতেই আমার পড়া হয়ে গিয়েছিল দীপ্তি ত্রিপাঠীর সমালোচনা গ্রন্থ ‘আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়’ আর বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’। দীপ্তি ত্রিপাঠীর মাধ্যমে পরিচয় ঘটল তিরিশি আধুনিক বাংলা কবিতা ও তার বৈশ্বিক পরিসরের সাথে। সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী ও জীবনানন্দ দাশের সাথে তখন বেশ অন্তরঙ্গতা। নীলক্ষেত থেকে খুঁজে খুঁজে পড়ি তাদের বই আর গোগ্রাসে গিলি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা।

সাহিত্যের জগতে বুদ্ধদেব বসুর গদ্য আমার প্রথম প্রেম। তার ছবি সংগ্রহ করতে ঢাকার পথে পথে অনেক ঘুরেছি। ধীরে ধীরে ভালো লাগা ছুটেছিল সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হুমায়ুন আজাদের দিকেও। স্কুলে থাকতে আব্বার সংগ্রহের ধর্মীয় বইগুলোর সব পড়েছি। মনে আছে, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের `জীবন সমস্যার সমাধানে ইসলাম` বইটি পড়তে গিয়ে কি শ্রমই না দিয়েছি। পিতার সংগ্রহের বার্টান্ড রাসেলের ম্যারিজ অ্যান্ড মরালস (অনুবাদ) আর সেক্সুয়াল লাইফ ইন ইংল্যান্ড বই দুটি পড়ার চেষ্টাও করেছিলাম অষ্টম-নবম শ্রেণিতে থাকাকালে। পাঠ্য বইয়ের বাইরের পড়াশুনার প্রতি বিপুল আগ্রহের কারণে নটরডেম কলেজে পড়া সত্ত্বেও ইন্টারের রেজাল্ট হয় গড়পড়তা, অথচ এসএসসির রেজাল্ট ছিল প্রায় `স্ট্যান্ড` করার কাছাকাছি। ভেবেছিলাম এক বছর ড্রপ দেব, এবং নানা বিষয়ে পড়াশুনা করে সামনের বছরে কোনও একটি য়ুনিভার্সিটিতে ভর্তি হব।

তাই ইন্টারের ফল প্রকাশের পর পরই বঙ্কিম ও শরতের সব উপন্যাস পড়ে ফেলি। আমার আর কলেজের এক বন্ধুর তন্নতন্ন করে পড়া হয় `গল্পগুচ্ছ`ও। যা হোক, এক বছর ড্রপ দেয়ার সাধ পূরণ হয়নি; আমি জাবি`র ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই। কবিতা লিখি। কম জানলে যেমন অনেক বোকা বোকা গর্ব হয়, তেমনি আমারো মনে এক গর্ব ছিল। ভাবতাম, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পর একমাত্র আমিই বিপুল প্রস্তুতি নিয়ে বাংলাসাহিত্য করতে এসেছি এ দেশে। কবিতা নিয়ে তখন খুব সিরিয়াস আমি। প্রেমের কবিতা লিখবো না বলে মনস্থির করেছি। লিখিওনি। কেন যেন এই দুশ্চিকিৎস্য অপধারণা হইছিল আমার যে, কেউ চিত্তের দুর্নিবার চাঞ্চল্যে প্রেমের কবিতার উদগীরণ করতে থাকলে সে দীর্ঘমেয়াদে কবি থাকার অনুপযুক্ত হয়। এখন এসব ভাবলে হাসি পায়।

আমার নানামুখী পড়াশুনার তোড়ে হুমায়ূন পড়ার সময় আর হয়ে ওঠে নাই। তবে চোখ কান খোলা রাখি বলে হুমায়ূন ভক্তদের চেয়ে তার সম্পর্কে খুব কম জানি, এমন নয়! হুমায়ূন আহমেদ যথেষ্ট পড়িনি বলে কিছুটা আক্ষেপ হয়, তবে এখন আর এ-আক্ষেপ মেটানোর কোনও উপায় নেই। নির্ধারিত কিছু বিশেষ পড়াশুনার বাইরে হয়তো আর ফিকশন পড়ার সুযোগ হবে না আমার। সরি হুমায়ূন। তবে আপনার পাঠকপ্রিয়তা বাড়বে নাকি কমবে, জানি না। জীবদ্দশায় আপনি আপনার উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা দেখে গেছেন; শুধু ফিকশন লিখে এমন বিত্ত, বৈভব ও খ্যাতি আপনার মতো করে এদেশে কেউ আর উপভোগ করেনি। জীবনের নানা দান আপনি পেয়েছেন অফুরন্ত। যেটুকু আপনার না-পাওয়া, সেটুকু মানব জনমেরই ধর্ম। আপনার রূহের শান্তি ও মাগফেরাত কামনা করি।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক