বদরুদ্দীন উমর

বদরুদ্দীন উমর

জগলুল আসাদের গদ্য ‘বদরুদ্দীন উমরের পথ ও পদ্ধতি’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২১, ২০১৯

বদরুদ্দীন উমর ‘বামনের দেশে মহাকায়’। এখনো রাজনীতির অনেক সত্য তিনি প্রকাশ করেন অকুণ্ঠচিত্তে। অদ্যাবধি তাঁর সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ‘সংস্কৃতি’ নামের পত্রিকাটি। সমাজ রূপান্তরের এই নেতা, চিন্তক ও কর্মীর কাছে আমাদের জন্যে আছে অপরিমেয় শিক্ষণীয় বিষয়। তিনি মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদ। সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলবার তাঁর যে সাহস, তা অনুসরণীয়। তাঁর সমস্ত মার্ক্সবাদী চিন্তা ইতিহাসকে আশ্রয় করে স্ফূর্তি পায়। বদরুদ্দীন উমর আমদের শেখান, বড় পরিসরে ইতিহাসকে দেখলে সেখানে পাওয়া যায় আশার যোগান, এবং ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করেই পাওয়া সম্ভব বর্তমানের কণ্টকিত পথে চলবার দিশা। বদরুদ্দীন উমর এ মুলুকে ইতিহাসের অন্যতম সেরা কারবারি।

মার্ক্সীয়বীক্ষা অনুসারে কীভাবে ইতিহাস রচনা করতে হয়, সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষণ করতে হয়, তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন হাতে-কলমে। সে হিশেবে, তাঁর ইতিহাস বিশ্লেষণের প্রধান টুলস হচ্ছে: শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণ ও শ্রেণিস্বার্থ বিবেচনা। কোনও ঐতিহাসিক চরিত্র যখন তিনি বিশ্লেষণ করেন, তখন জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে চরিত্রটি কীভাবে তার শ্রেণি স্বার্থেরই প্রতিভূ থাকেন, তা দেখান। উমরের কাছে ইতিহাসে ব্যক্তির মূল্য অপরীসিম। কারণ ব্যক্তি তার শ্রেণি ও সম্প্রাদায়ের প্রতিভূ হওয়ার পাশাপাশি, তাদের চালিকাশক্তিও। ব্যক্তি নিছক ব্যক্তি নয়, সে তার শ্রেণির মুখপাত্র ও প্রতিনিধি— এই প্রতিপাদ্য থেকে উমর কখনোই সরে যান না।

তিনি তাঁর প্রাথমিক ও মধ্যজীবনের কাজগুলোতে প্রতিক্রিয়াশীলতা-প্রগতিশীলতার বাইনারি তত্ত্বের আলোকে ব্যক্তি ও ঘটনাকে বিশ্লেষণ করেছেন। ঔপনিবেশিক আমলে প্রগতিশীলতার অর্থ কী, এটি বিশ্লেষণে বদরুদ্দীন উমর শ্রম দিয়েছেন অনেক। ঊনবিংশ শতকে প্রগতিশীলতা ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরোধিতা করা, কারণ এই বিরোধিতার ফলে কৃষক স্বার্থের পক্ষে যেমন থাকা হয়, একইভাবে ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতিভূ হিশেবে জমিদারদের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে এই ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতাও হয়। ঔপনিবেশিক আমলে সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলন আসলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনই। ধ্রুপদী মার্ক্সবাদের ‘ভিত্তি ও উপউরিকাঠামো’ এই কাঠামোর আলোকে তিনি প্রায় পুরো উনিশ শতককে তিনি ব্যাখ্যা করেন।

উনিশ শতকে, তাঁর মতে, মধ্যবিত্ত বাঙালির আর্থিক জীবনের মূলভিত্তি ছিল: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। আর এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই তিনি ব্যাখ্যা করেছেন উনিশ শতকের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি নামক উপউরিকাঠামোকে। উমর নিষ্ঠ থাকেন মার্ক্সের Base- Superstructure তত্ত্বের কাঠামোয়। এই কাঠামো ব্যবহার করে তিনি রচনা করেন তাঁর ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ’ নামক গ্রন্থটি। বিদ্যাসাগরের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বদরুদ্দীন উমর মনে করেছেন, কৃষক স্বার্থের প্রতি ঔদাসীন্যই বিদ্যাসাগরের চিন্তার পরিধি টেনে দিয়েছে। এভাবে ধ্রুপদী মার্ক্সিস্ট বীক্ষাতে কঠোর আনুগত্যে বদরুদ্দীন উমর ব্যাখ্যা করেন উনিশ শতকের সমাজ ও সংস্কৃতি।

ভিত্তি ও উপউরিকাঠামোর যে মিথস্ক্রিয়ার কথা আলথুসার বলেন, সে-ই তাত্ত্বিকজ্ঞান উমর তাঁর এই আলোচনায় ব্যবহার করেননি। ফ্রেডরিক জেমসন উল্লেখিত আলথুসারের যে অভিযোগ ‘ভালগার মার্ক্সিস্ট’দের বিরুদ্ধে ছিল, তা বদরুদ্দীন উমরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাছাড়া তিনি ধর্ম সংস্কার আর সমাজ সংস্কারকেও প্রায় দুই মেরুতে রেখেছেন, এবং বিদ্যাসাগরকে তিনি প্রশংসা করেছেন এই বলে যে, বিদ্যাসাগর সমাজ সংস্কারকে ধর্ম সংস্কারের আবর্তে নিক্ষেপ করে রক্ষণশীলতাকে প্রশস্ত করেননি। এইখানে উমর কিন্তু সমাজ বিকাশে ধর্মচিন্তা ধর্মীয় আন্দোলন ইত্যাদির যে ভূমিকা তাকে গৌণ করলেন। পরবর্তী কালে সাব-অল্টার্ন হিস্টোরিয়ানদের হাতে এই গৌণতার উপশম ঘটবে, যদিও বিবেক চিবরের তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হবেন এই নিম্নবর্গের ইতিহাসব্যবসায়ীরা। যদিও অনেকে মনে করেন, সাবঅল্টার্ন হিস্টোরিওগ্রাফির আদি কিছু নিদর্শন উমরে লভ্য।

মার্ক্সীয় হার্মেনিউটিক্স অনুসারে, ইতিহাসের কোনও কালপর্ব একটি প্রধান দ্বন্দ্ব (Principal Contradiction) থাকে, তবে একাধিক অপ্রধান দ্বন্দের চোরাস্রোতও থাকে। শ্রেণি দ্বন্দের পাশাপাশি উমর লক্ষ্য রাখেন ইংরেজ-ভারতীয় দ্বন্দ্ব, অর্থাৎ উপনিবেশক-উপনিবেশিত দ্বন্দ্ব, হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব, ও স্বাধীনতা-উত্তর কালে উর্দু-বাংলা দ্বন্দ্বের দিকেও। আলগোছে তিনি ‘ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন’ বইয়ে ব্যবহার করেন মাও জেদং কথিত মিত্রতামূলক দ্বন্দ্ব ও বৈরী দ্বন্দ্বের ধারণাও Antagonistic Contradictiom। ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বদরুদ্দীন উমরের অন্যতম প্রধান চাবি ধারণা। তাঁর চিন্তায়, ‘দেশভাগ’ এর পটভূমিতে ‘হিন্দু-মুসলমান’ এর সম্মিলিত স্বার্থের জন্যে যারা কাজ করে তারা প্রগতিশীল, আর যারা কাজ করে বা ভাবে স্ব স্ব সম্প্রদায় নিয়ে তারা ‘সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক’। এই ভাবে ভারতের জাতীয় ইতিহাস বদরুদ্দীন উমরের হাতেও, বিরল কিছু ব্যতিক্রমী মুহূর্ত বাদ দিলে, বর্ণহিন্দু ও মুসলমান্দের ইতিহাস হিশেবেই চর্চিত হয়। বাদ পরে নমশুদ্র, দলিত ও তফশিলি সম্প্রদায়। তাছাড়া, বাদ পরে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে উলামা শ্রেণির ভূমিকাও। উমর নিজেও কে কোন বিষয় সম্পর্কে উদাসীন থাকে তা দিয়ে শ্রেণি চরিত্র বিশ্লেষণ করতে চান। তাঁর পদ্ধতি দিয়ে তাঁকেও মাঝে মাঝে মাপা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না।

উমর খুব সচেতন ঐতিহাসিক। হিন্দু বা মুসলিম, এমনকি বাঙালি জাতীয়তাবাদী ইতিহাস ধারায় তিনি নিজেকে যুক্ত করেন না। তিনি ঐতিহাসিক বস্তবাদের বস্তুনিষ্ঠতা চর্চা করতে চান, যার ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ উমরের নজর এড়িয়ে যায়, আঙুলের ফাঁক গলে ঝরে যায়। তিনি কিন্তু বঙ্গীয় রেনেসাঁ নামক সোনার-পাথর বাটির ক্রিটিক করেন, সোনার বাংলার মিথ সম্পর্কেও তিনি সচেতন সেই সত্তর-আশির দশক থেকেই। সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে হিন্দু ও মুসলিম নেতা প্রত্যেককেই পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী সাম্প্রদায়িক বলতে পারেন তিনি। যদিও ধর্মের ভূমিকা প্রশ্নে অন্যান্য মার্ক্সবাদীদের মতোই তিনিও হয়ে যান টলোমলো, আটকা পড়েন ‘পশ্চাৎপদতা ও অগ্রসরতার’ যুগ্ম-বৈপরীত্যের ফাঁদে।

বদরুদ্দীন উমরের সুস্বাস্থ্য কামনা করি। অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে বেছে নিলাম তাঁর চিন্তাকে, সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও, পর্যালোচনা করার দুঃসাহসী দায়িত্ব। ভাবলাম এটাই তাঁকে সম্মান জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায়। একদা তারুণ্যে তাঁকে গোগ্রাসে পড়তাম, এ বেলায় তাঁকে আর পড়া হয় না। আর হবেও না হয়তো, তেমন মনোযোগ দিয়ে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নিবিষ্টতা নিয়ে। আমাদের অনেকেরই তিনি একদার প্রেম, এখনও বিস্ময়। জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাই জনাব বদরুদ্দীন উমর বিন আবুল হাশিমকে।

লেখক: কলামিস্ট ও শিক্ষক