জীবনানন্দ বনাম একাডেমিক কসরত

কুদরত এলাহি

প্রকাশিত : মার্চ ০৪, ২০২০

জীবনানন্দ কোনো চাকরি ধরে রাখতে পারে নাই। একপর্যায়ে  কলেজ শিক্ষকতার পদ হারানোর পর, তাকে নতুন করে কোনো শিক্ষকতা বা পত্রিকার কোনো কাজে কেউ আর ডাকছিল না। উনিও আরো গভীর অন্যমনস্কতায় ডুবে যাচ্ছিলেন।

জীবনানন্দকে ঘিরে বসা পাইকারি বা খুচরা একাডেমিকদের সহজ বাংলাতে কিছুতেই অন্যমনস্ক বলা যাবে না। এদেরকে কঠিন বাংলায় মগ্ন চৈতন্য প্রবাহের অনুসারীও বলা যাবে না। পরাবাস্তব, অবচেতনা ইত্যাদিকে এরা নেয় কৌশল হিশেবে। সব কৌশল জোড়াতালি দিয়ে এরা জীবনানন্দ ঘিরে একটি করে খাওয়া কুটিরশিল্প গড়ে তুলেছে। এর সাথে জীবনানন্দ পাঠকের সম্পর্ক নাই, সে সম্পর্ক যতই অজ্ঞ বা বিজ্ঞ হোক না কেন।

কুটির শিল্পকে নির্ভর করে অনেকে নামের পাশে বসিয়ে দেন, কবি ও জীবনানন্দ গবেষক। আবদুল মান্নান সৈয়দ ও বিনয় মজুমদার এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এরা দুজনেই জীবনানন্দের অপার ভক্ত। কিন্তু জীবনানন্দকে তাদের সামাজিক, একাডেমিক উত্তরণের সিঁড়ি করে তোলেন নাই। মান্নান সৈয়দ সাহিত্যে পিএইচডি করবার পরও মোটা দাগে, এমন কি সূক্ষ্ম দাগেও তাকে একাডেমিকদের সাথে মেলানো যায় না। কবিতার উৎকর্ষতার পাশাপাশি অঙ্কশাস্ত্রে অবদান রাখার পরও বিনয়কেও একাডেমিক বলা যাবে না।

একাডেমিক কি করে? সে তার কথিত গবেষণা ও অগাধ রুটি-রুজির ধান্দায় সমকালীন কবিতা ও সাহিত্যের বাঁকগুলোকে আড়াল করে। একাডেমিক ও গৌণ সাহিত্যিকেরা ভিড় করে পারস্পরিকভাবে এ কাজটি করে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে ঘিরে এটি হচ্ছে মহা সমারোহে। চর্চার আন্তরিকতার চেয়ে অনেক বেশি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ব্যাবহার করা হয় আড়াল করবার প্রবণতা থেকে।

জীবনানন্দকে নিয়ে আনুষ্ঠানিক একাডেমি গঠন করা হলে যে তা একাডেমিকেরা এবং গৌণ সাহিত্যিকেরা সমকালকে আড়াল করতে আরো জোরেসোরে ব্যাবহার করবে, তা লেখা বাহুল্য। এর ভেতর বিনয় ও মান্নান সৈয়দ কেন্দ্র করে যেসব ঢাউস সঙ্কলন প্রকাশ করা হচ্ছে তাতে এ প্রবণতা স্পষ্ট। জীবনানন্দ এখনো সেই ট্যুরিস্ট স্পট, যেখানে কথিত ইকো পার্ক বানিয়ে, রিসোর্টে কাত হয়ে শুয়ে পাশের ক্ষেত থেকে কাটা তাজা আনারস খাওয়ানো হচ্ছে না। কিন্তু একাডেমিকেরা তাই করতে চাচ্ছে।

ধরা যাক, একজন গৌতম মিত্রের কথা। ওনার নামের পাশে বসানো হয়, কবি ও জীবনানন্দ গবেষক। বাজার সয়লাব করে ফেলেছেন জীবনানন্দকে ঘিরে। তারপর ভনভন করছেন ফেসবুকে, তাবৎ ধরনের সাহিত্যপত্রে। মিত্র মহাশয় আমাদের এমন কোনো তথ্য দিচ্ছেন না যা মান্নান সৈয়দ, বুথ সিলি আমাদের দেন নাই। ক্লান্তিকর পুনরাবৃতির ভেতর মিত্র মহাশয় আমাদের মনে করিয়ে দেন জীবনানন্দের অমুক কবিতাটি এলেন পোর মতো, তমুক কবিতাটি ইয়েটসের মতো।

এরপর উল্লেখিত কবিতাগুলোর নিজের অনুবাদ জীবনানন্দের কবিতাটির পাশে পরিবেশন করেন এবং ধরা পড়েন। ভাষা, ব্যাকরণ, বানান ইত্যাদি ঠিকঠাক থাকার পরও সেসব অনুবাদগুলো পুরোটা পড়তে মন চায় না, নন্দনরসে সেগুলো এত দুর্বল! এটা মান্নান সৈয়দ পড়বার সময় আমাদের মনে হবে না। এমনকি বুথ সিলিও জীবনানন্দের ইংরেজি তর্জমায় সফল হবার পরও নিজের লেখা কবিতাতে খুব দুর্বল।

মিত্র মহাশয়েরা কিছুকাল টিকে যান, এটা ওটা পুরস্কার পান, কোনো একজন মাসউদ আহমাদ এসে জীবনানন্দ নিয়ে যত বাহুল্য নির্জিত, উচ্চাভিলাষী মেদ আছে তার পাহাড় তৈরি করে, তার চূড়ায় অধিষ্ঠিত করেন মিত্র মহাশয়দের।

মেদের পাহাড় যে আসল পাহাড় নয়, তা কি আর লিখে বলে দিতে হবে! নিজেদের মেদের চাপে এরা নিজেরা হাঁসফাঁস করেন। কাউকে কাউকে দেরি করিয়ে দেন। একটা হিশাব এদের থাকে। প্রায় শত খানেক সাহিত্যরসোপ্রার্থীর থেকে এরা লেখা নেন। তারপর এ শতখানেক অংশগ্রহণকারী একই সাথে তাদের ক্রেতা ও বিক্রেতাতে রূপান্তরিত হন। এর সাথে যোগ হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিচালাক আলগোরিদম, অমুকেরটাতে কিছুতেই মন্তব্য করবো না, তাহলে তমুকেরা দেখে ফেলবে।

দেরি করিয়ে দেবার একাডেমিক মচ্ছবে মিডিয়াও এসে যোগ দেয়। সেলফি তোলে। পাঞ্জাবি ও শাড়ি দোলায়। প্রকৃত কবিতা তার স্বভাবি, স্বতোৎসারিত অট্টহাসি নিয়ে লক্ষ্যভেদী হতে থাকে।