তানিম, বাপ্পি, নাজির রোড, ফেনী

তানিম কবির

প্রকাশিত : এপ্রিল ১১, ২০১৯

আমার দিনগুলা কিভাবে যায়। সেই শুরু থেকে। যখন থেকে বুঝতে পারলাম দিন যায়। আমি কি হিসাব করে দেখছি কখনো? মনে হয় না। সর্বোচ্চ হইতে পারে, হিসাব করতে বসার একটা তাগিদ তাৎক্ষণিকভাবে অন্যকিছু করাইয়া নিছে। কী? একটা স্মুথ বিকাল দেইখা ঘর থেকে বাইর হওয়ার উৎসাহ পাইছিলাম হয়তো। ভাবতে অবাক লাগে, ২০০৫ সালে আমি আমার এক বড়ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতেছিলাম। কথা বলতেছিলাম আমাদের হারাইয়া আসা দিনগুলা নিয়া। তারও আগে, ২০০০, ০১, ০২, ০৩ সালে আমরা যখন একসাথে ক্রিকেট খেলতাম, সেইসব দিনগুলা নিয়া। তারপর একদিন অনেক ছোটবেলার বন্ধু বাপ্পিকে ফোন দিয়া বলছিলাম, বাপ্পি আয় তো একদিন দেখা করি। অনেকদিন দেখা নাই। সেটাও অন্তত ২০০৬ সালে। আমি আর বাপ্পি আলপিনে লিখতাম। তানিম, বাপ্পি, নাজির রোড, ফেনী। লেখার শেষে ঠিকানাসহ এভাবেই আমাদের দুইজনের নাম থাকত। অনেকেই ভাবত আমরা আপন ভাই। আসলে আমাদের মধ্যে একটা চুক্তি হইছিল। বাপ্পি বা আমি, যে-ই যা লিখি, নাম যাবে দুইজনের। সেই ভিত্তিতে প্রথম প্রায় দশটা লেখাই যখন আমার পাঠানোগুলোই ছাপা হলো আর বাপ্পির পাঠানোগুলোর একটাও না; বাপ্পি তখন এই মর্মে হীনমন্য হইল যে, “আমার নাম বাদ দে তানিম।”

আমি রাজি হইলাম না। বললাম, “দ্যাখ ‘তানিম, বাপ্পি’ এটা একটা ব্রান্ড হইয়া গেছে। এখন পাল্টানো ঠিক হবে না।” ভাগ্য ভালো বা বাপ্পির বাড়তি পরিশ্রমের সাপেক্ষে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বাপ্পির পাঠানো একটা লেখা ছাপা হইল। বাপ্পির আনন্দ আর দেখে কে। আমারে ম্যাক্সফুডে নিয়া গিয়া সমুচা খাওয়ায়। ঘনঘন কোলাকুলি করে। বলে, “আমরা দুইজন মিলাই যা করার করব, কী বলিস?” আমিও শুধু আমার লেখাই ছাপা হওয়ার মানসিক চাপ থেকে উদ্ধার পাইয়া হাসিখুশি থাকি। এরপর কী যেন হয়, অনেকদিন আমি আর তেমন কিছু লিখতে পারি না। এগুলা ২০০২-২০০৩ সালের ঘটনা। এদিকে বাপ্পি একটা লেখা ছাপা হওয়ার উত্তেজনা ও উৎসাহে আরো ভালো ভালো লেখা পাঠাতে থাকে। এবং নিয়মিতভাবে সেগুলা ছাপাও হইতে থাকে। কিন্তু এক আজব ব্যারাম, নিজে লিখি নাই অথচ নিজের নাম ছাপা হচ্ছে সাপেক্ষে আমার মধ্যে আর কোনো ভালো লাগা কাজ করে না। এরমধ্যে আমাদের মধ্যে কী নিয়া যেন দূরত্বও বাড়ে। আমরা কথা বলাবলি বন্ধ কইরা দিই। কারো সাথে কারো আর দেখাও হয় না। তবু আমরা ‘তানিম, বাপ্পি’ নামেই লেখা পাঠাই। কখনো আমার পাঠানোগুলা আবার কখনো ওর পাঠানোগুলা—উভয়ের পাঠানোগুলাই দুজনের নামে ছাপা হইতে থাকে।

২০০৬ সালে, ৩ বছর পর যখন ওকে ফোন করি। ততদিনে আলাদাভাবে আমি কবি হইয়া গেলেও বাপ্পি তখনও ফান ম্যাগাজিনেই লেখালেখি করে। আমার দেশ পত্রিকার ভিমরুল নামের একটা ফান ম্যাগাজিনে সে তখন তার পুরো আমজাদ হোসেন বাপ্পি নামেই লেখে। আর আমি অপেক্ষাকৃত সিরিয়াস ভঙ্গির লেখালেখি করি; যেগুলার বেশিরভাগই ছাপা হয় দেশের বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনগুলাতে। দেখা হওয়ার পর বাপ্পি ভাবে আমি লেখালেখি ছাইড়া দিছি। “বন্ধু তুমি তো আর লিখলা না।” সে আমাকে বলে। আমি বলি, “আরে বোকা, আমি এখন কী লিখি জানোস? কবিতা লিখি ব্যাটা! পড়লে হাসি আসে না, এমন সব গল্প লিখি।” এই শুনে বাপ্পি হাসতে হাসতে শেষ। বলে, “তুই তাহলে আতেল হইয়া গেছোস বন্ধু!” আমি বাদ দিতে বলি, “থাক তোরে বুঝানো যাবে না।” কিন্তু এবার সেও সিরিয়াস হয়। বলে, “অসুবিধা নাই। ক্লাশ সেভেনের বছর লেখা তোর উপন্যাসটা তো পড়ছিলাম। ভালোই ছিল সেটা। কী যেন নাম ছিল?” আমি ঝলমল করে উঠি। বলি, “নীরদ”। তারপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে পুরনো সব জায়গায় যাই। আগে যেসব জায়গায় যাইতাম, তেমনসব জায়গায়। যেমন রাদিয়াদের বাসার সামনে গিয়া দাঁড়াই। বাপ্পিরে বলি, “আফসোসটা কী জানোস? সিরিয়াসলি লেখালেখিটা শুরু করার আগেই রাদিয়ার বিয়া হইয়া গেল। .. বাপ্পিও একমত হয়।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক