তারা মানসিকভাবে অসুস্থ

বেলায়াত হোসেন মামুন

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৯, ২০১৯

বর্তমান সরকার, আওয়ামী লীগ এবং সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার সমালোচনা যে কেউ করতে পারেন তাতে অসুবিধার কিছু নেই। কিন্তু বর্তমান সরকার, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সমালোচনার পথ ধরে ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ডকে `ঠিক` ছিল বলার সুযোগ নেই। কারণ ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ যে নারকীয় ঘটনার জন্ম দেয়া হয়েছিল, তা কোনো রাজনীতি নয়, তা ছিল স্থির মস্তিষ্কের কিছু মানুষের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডকে যে বা যারা সমর্থন করে সে নিশ্চিতভাবে ১৫ আগস্টের খুনিচক্রের আদর্শের অনুচর অথবা মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ এর বঙ্গবন্ধুর সরকারের বহু সাফল্যের সাথে সাথে বহু ব্যর্থতা অবশ্যই আছে, সে সব বিষয়ে যুক্তিপূর্ণ আলোচনা হতেই পারে। রাজনীতি করতে হলে সেসব বিষয়ে রাজনৈতিক বাহাস হতে পারে, কিন্তু সেসব পথ পরিহার করে একজন মানুষকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করার জন্য খুন করা কী ধরনের রাজনীতি? আর এই ভয়াবহ ঘটনাকে `বৈধ` মনে করে গলাবাজি করা কী ধরনের বিবেচনাবোধ?

সম্প্রতি এই ধরনের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। দুজন চলচ্চিত্রকর্মীর সাথে এই তর্ক আমার হয়েছে। আমি প্রচণ্ডভাবে আহত হয়েছি এই তর্কে। আমার ভাবতে কষ্ট হয়েছে যে, দুজন সচেতন চলচ্চিত্রকর্মী, যারা তরুণ এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন তারা কী তেজের সঙ্গে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডকে `সঠিক কাজ` বলে উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন। আমি তাদের যখন বললাম, বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনীতিবিদ এবং সরকার প্রধান, তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন না করে তাঁর পরিবারের নারী-শিশু এবং রাজনীতির সাথে সম্পর্কহীন সদস্যদের হত্যা করা কিভাবে যুক্তিযুক্ত হতে পারে?

আমার এই প্রশ্নের উত্তরে তাদের যেসব জবাব ছিল তা আমি লিখতে চাইছি না। কারণ তা এতটা অসংবেদনশীল কথা যা লিখে কাউকে পড়তে দেয়াটাও মানসিক নির্যাতনের শামিল। তাদের সেসব কথার জবাবে একপর্যায়ে আমি তাদের একজনকে বললাম, তাহলে আপনার কোনো অপরাধ বা ব্যর্থতায় আপনার স্ত্রী বা কন্যাকে `আক্রমণ` করা `ন্যায়` বলে আপনি মনে করেন? তখন সে চলচ্চিত্রকর্মী রেগে গেলেন। বললেন, আমি রাজনৈতিক তর্ককে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমি বললাম, তা নয়, যদি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও সরকারি দায়িত্ব পালনে কোনো ব্যর্থতা হয়ে থাকে তবে তার রাজনৈতিক প্রতিবাদ হতে পারে, কিন্তু ওনার পরিবারকে এবং ওনাকে খুন করা যেতে পারে না। যদি বঙ্গবন্ধুর ব্যর্থতায় ওনার পরিবারকে আক্রমণ করা আপনার চোখে `সঠিক` হয়ে থাকে তাহলে আপনার অপরাধে আপনার পরিবারকে `আক্রমণ` করা সঠিক হবে না কেন?

এই তর্কের একপর্যায়ে ওনাদের ভয়াবহ কুযুক্তি বর্ষণের উত্তেজনা আর নিতে পারছিলাম না। আমার কেবলি মনে হচ্ছিল, এই মানুষ দুজনকে আমি চিনি না। এদের এসব কথা আমি কেন শুনছি? তখন আমি তাদেরকে থামিয়ে দিয়ে বলি, যারা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের নারকীয় হত্যাকাণ্ডকে `সমর্থনযোগ্য` কাজ মনে করে তারা মানসিকভাবে অসুস্থ। আমি এমন মানুষদের সাথে কথা বলতে রাজি নই। এমন মানুষদের সাথে আমার `সামাজিক` সম্পর্ক রাখাও অসম্ভব।

বলে রাখি, এই ঘটনা ঘটেছে ১৩ নভেম্বর রাতে। সে দিনের সে তর্কের পর থেকে আজকে পর্যন্ত আমি মানসিকভাবে ডিস্টার্ব হয়ে আছি। দুটো কারণে এই ডিস্টার্বনেস। একটি হলো, যে দুজনের সাথে আমার এই তর্ক হয়েছে তাদের একজনকে আমি চিনি বহুবছর ধরে। আরেকজনকে বছর চারেক হবে হয়তো। যাকে বহুবছর ধরে চিনি তিনি কোনোভাবেই পাকিতন্ত্রের আদর্শের মানুষ নন। তবে কেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে তিনি এতটা তেজের সঙ্গে সমর্থন করলেন? আর যাকে মোটামুটি চার বছর ধরে চিনি তিনি এক আলোচনায় বলেছিলেন, তিনি পিঁপড়াদের জীবনকেও রক্ষা করার চেষ্টা করেন, কোনো প্রাণের ক্ষতি হোক এটা তিনি চান না। সেই তিনি কী করে ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ডকে `ঠিক ছিল` বলে গলাবাজি করতে পারেন?

আর সর্বোপরি, এমন মানুষদের সাথে আমার সামাজিক-চলচ্চিত্রিক সম্পর্ক আছে ভেবে চারদিন ধরে আমি ভয়ানক ডিস্টার্ব আছি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আফটারম্যাথ সম্পর্কে এই দুজন মানুষ কিছুই জানেন না, এমনটা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। এতটা ইতিহাস অসচেতন মানুষ তারা নন। আর সব কিছু জেনে বুঝে আজকের দিনের কোনো চলচ্চিত্র নির্মাতা ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডকে কিভাবে সমর্থন করতে পারে! রাজনীতির জবাব রাজনীতি না হয়ে গুম-খুন-হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করার মানসিকতা কিভাবে সৃষ্টিশীল কাজে যুক্ত মানুষ পোষণ করতে পারে? তাহলে তারা কীসের সৃষ্টিশীলতার কাজ করে?

লেখক: চলচ্চিত্র সংসদকর্মী ও সংগঠক