প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

তৌফিকুল ইসলাম পিয়াসের আত্মগদ্য ‘শৈশব কৈশোর’

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৭, ২০২০

একটি ছোট নদী, বড় একটা খেলার মাঠ, হাঁটার জন্য গ্রামের ভেতর দিয়ে মেঠো পথ। কোথাও আবার ছোট একটা খাল। সেই খালটি যখন ওই মেঠো পথটিকে ভেদ করে চলে যেন তখন সেখানে তৈরি করা হতো একটা কাঠের বা কাঁচা বাঁশের সাঁকো।

সেই সাঁকোতে চড়ে সারাদিন বসে থাকা, অপ্রয়োজনে এপার-ওপাড় করা। সামান্যর চেয়ে একটু বেশি বৃষ্টি হলে সেই ছোট খালটিতে বৃষ্টির পানির একটা সাময়িক স্রোত বয়ে যেত। খালকে আমরা আদর করে বলতাম ‘হালট’। সেই সাময়িক স্রোতের পানিতেও ভেসে যেত কয়েকটা ছোট ছোট মাছ। জানতেই পারিনি কোনও দিন, সেই সাময়িক বৃষ্টির জমে থাকা পানির স্রোতে কোত্থেকে এলো এসব মাছগুলি?

আমি তখন ক্লাস টুতে পড়ি। কিম্বা হতেও পারে ক্লাস থ্রি। আমাদের বাড়ির সামনে যে ছোট শান্ত নদীটি বয়ে চলছে অবিরাম, সেটাকে ড্রেজিং করা শুরু হলো। সেই ড্রেজিংয়ের ‘পানি-কাদাময়’ মাটি ফেলা হতো আমাদের সেই আদরের হালটে, মানে খালটিতে, মাটিতে ভরে গেল খালটি; চোখের সামনে মৃত হয়ে গেল দীর্ঘ শত বছরের ছোট খালটি। এখনও খুব মায়া হয় আমার সেই হারিয়ে যাওয়া খালটির জন্য। আহা, কত স্মৃতি সেই খালটিকে ঘিরে আমার কৈশোরের, শৈশবের। প্রতি বন্যা মৌসুমে ভরে উঠতো সেই ছোট খালটি, মানে আমাদের হালটটি।

কতগুলি কলাগাছ কেটে নিয়ে আসতাম। তারপর একটা বাঁশকে ছোট ছোট করে কেটে তারপর দু’ভাগ করে একটার পর একটা কলাগাছকে জোড়া লাগিয়ে নিজের হাতে তৈরি ছোট্ট সেই ভেলা। আরও একটি বাঁশ কেটে তৈরি করতাম লগি। তারপর সেই ভেলাটি ওই বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া খাল দিয়ে চালিয়ে চলে যেতাম অনেক অনেক দূরে। পুরো এলাকা তখন থৈ থৈ পানিতে ভরা। যেদিকে তাকাই শুধুই পানি আর পানি। ধানক্ষেতগুলিও পানিতে ডুবে রয়েছে। আরও অনেকটা গভীরে চলে যেতাম। সেখানে দেখা মিলতো শাপলা ফুলের। খুব শখ করে তুলতাম কিছু শাপলা।

বন্যায় প্রতি বছরই আমাদের বাড়ির সামনের খেলার বিশাল মাঠটিও ডুবে যেত। সেই মাঠে সাঁতার কাটতাম কত। বন্যার সময় পদ্মা নদীর ঘোলা পানিতে ভরে উঠতো আমাদের নদী, মাঠ, খাল। এমনিতে আমাদের নদীর পানি কিন্তু স্বচ্ছ পরিষ্কার। সেই বন্যার সময় ওই ঘোলা ও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটতাম। তারপর আস্তে আস্তে সেই পানি আবার ফিরে যেত নদীতে। কমতে থাকতো পানি। পানির এভাবে চলে যাওয়াটাও আমার ভালো লাগতো না, মন খারাপ হতো বন্যার জন্য।

শীতের দিনগুলি ছিল সবচে বেশি আনন্দের। স্কুল ছুটি হয়ে যেত। আমাদের গ্রামের ভেতরে একটি ‘উপগ্রাম’ রয়েছে। ছোট্ট একটা পাড়া। পাড়াটি হিন্দু অধ্যুষিত এবং এরা বলতে গেলে প্রায় সকলেই জেলে। এদের একটা মজার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এরা সরাসরি আফ্রিকান বংশোদ্ভুত। এদের গায়ের রঙ কালো, সেটা একমাত্র কারণ না; তামিলরাও কালো অথবা এমনটাও হতে পারে সারাদিন খালি গাঁয়ে নৌকায় করে নদীতে মাছ ধরে বিধায় কালো। কিন্তু আমার সেটা মনে হয় না। কারণ এদের মাথার চুল। তাদের অধিকাংশের মাথার চুলই আফ্রিকানদের মতো খুবই ঘন কোঁকরানো— ঠিক আফ্রিকানদের চুলের মতো। বাংলাদেশের বা ভারতের অন্য কোথাও এমন চুলের মানুষ আমি দেখতে পাইনি। এরা খুবই শান্ত, নিরীহ স্বভাবের। এবং আমাদের সংগে খুবই সহজভাবে মিলেমিশে থাকে। তারা ডিসেম্বর মাসে কালি পুজো করে।

আমাদের স্কুলের পরীক্ষা শেষ হবার পরপরই তাদের কালিপুজো শুরু হয়ে যেত। ছোট মেলার মতো হতো সেখানে। তারা খুবই আনন্দ করতো। যখনই মসজিদে আজান হতো বা নামাজের সময় হতো— তারা নিজ দায়িত্বে তাদের পুজো, ঢোল, মাইক বন্ধ করে দিতে। আর আমরাও বিকেলে, সন্ধ্যায় ওদের আনন্দ দেখতে শামিল হতাম। জেলেরা আমাদের মাঠে তাদের ভেজা মাছ ধরার জাল পরিষ্কার করে শুকোতে দিতো। আমি বিকেলে হালকা রোদে সেই জালের উপর বসে কত যে বিকেল কাটিয়েছি— তার হিসাবে ফুরোবে না। মাঠের সঙ্গেই একটা ছোট প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেই স্কুল ঘরটির সঙ্গেই ছিল একটা বড় ডুমুর গাছ। আর ওই ডুমুর গাছের উপরে উঠেও আমার কেটে যেত অসংখ্য আনন্দময় বিকেল।

মাগরেবের আজান হলেই ছুটতাম মসজিদে। ওজু, নামাজ শেষে সোজা ঘরে ফিরে পড়তে বসতাম। শীতের দিনগুলোতে পড়ার চাপ কম থাকতো। সেসময় গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। ৫টায় সন্ধ্যা হতো। পড়তে বসলেই ঘুমে চোখ খোলা কষ্টকর হয়ে উঠতো। ৭টার মধ্যে রাতের খাওয়া শেষ করেই লেপের ভেতরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়তাম। অনেক লম্বা রাত। কাটতেই যেন চাইতো না। খুব ভোরে উঠে যেতাম ঘুম থেকে। অনেক ধরনের খেলা চলতো আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খেলা নিয়ে মেতে থাকতাম। দেখা যেত একটাকা কিছুদিন খেলতাম দাঁড়িয়াবান্ধা। তখন টাকা কিছুদিন দাঁড়িয়াবান্ধা নিয়ে ব্যস্ত। সারাদিন খেলা আর খেলা। এরপর হয়তো কিছুদিন খেলতাম গোল্লাছুট। টানা কিছুদিন ডাংগুলি। ডাংগুলি খেলায় আমি বেশ উস্তাদ ছিলাম বলতেই হবে।

মাঝে আবার গ্রামের দক্ষিণ দিকে একটা ছোট জঙ্গলাপূর্ণ অঞ্চলে গিয়ে সাপ আর ভূতের ভয়ের মাথা খেয়ে কয়েকজন মিলে সংগ্রহ করতাম কীসব গাছের যেন লম্বা লতা। তারপর সেই লতা পরিষ্কার করে আমাদের বাড়ির সামনের বড় গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে ‘টারজান টারজান’ খেলা খেলতাম। ওওওওওওওঁওওও আওয়াজ করে জাম্প দিয়ে সেই লতা ধরে পার হয়ে যেতাম সেই হালটের এপার থেকে ওপাড়। আহা, কোথায় হারিয়ে গেল সেইসব দিনগুলি?

সিগারের খোসাকে তিন পার্ট করে ছিঁড়ে বানাতাম একধরনের ‘তাস’। তার একটা ভাঙা মাটির হাঁড়ির ‘চাড়া’ দিয়ে কয়েকজন মিলে সেই তাস খেলা খেলতাম। যে যত তাস জিততে পারবো সেই সেরা। কাঠের তৈরি লাটিম কিনতে পাওয়া যেত বাজারে। লাটিমও খেলতাম অনেক সময়। এছাড়া খেলতাম ‘সাঁতচাড়া’ নামের একটা খেলা। কাচের ‘গুলি’ও (বল) খেলতাম অনেক সময়— তবে এটা আমার ভালো লাগতো না। দুপুরে দল বেঁধে নেমে পড়তাম নদীতে। সেই পানিতেও ভেসে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নামটা মনেই করতে পারছি না ‘ছোঁয়া-ছুয়ি’ জাতীয় কী একটা খেলাও খেলতাম অনেকে মিলে; মাঝে মধ্যে ফুটবল নিয়েও খেলতাম।

ক্লাস থ্রিতে যখন উঠলাম। দৌড়, হাইজাম্প, লংজাম্পে খুবই ভালো ছিলাম। খেলতাম বড় ভাইদের সঙ্গে। তারপর একদিন হাইজাম্প দেবার সময় গ্রামের এক বড় ভাই একই সময়ে জাম্প দিয়ে এসে পড়লো আমার পায়ের উপর। তারপর ভেঙে গেল আমার বাম পাটি। ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে পলেস্তারা করে রাখা হলো প্রায় দেড় মাস। পা আমার ঠিক হলো কিন্তু তারপর স্পোর্টসে সাহস হারিয়ে ফেললাম। সাইকেল চালাতাম প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক চাকার একটা গোল লোহার রিংকে কিভাবে নিয়ে যেন গ্রামের এমাথা থেকে ওমাথা চালিয়ে বেড়াতাম; সে এক অদ্ভুত নেশা ছিল।

ব্যাডমিন্টন খেলাটা আমার বরাবরই খুব ফেভারিট খেলা ছিল। একটা পা একবার ভেঙে যাওয়ায় কখনোই ফুটবল খেলতাম না, ভলিভলও না। তবে ব্যাডবল খেলতাম। ব্যাডবল খেলাটা আমার খুবই পছন্দের একটা খেলা ছিল। খেলাটা অনেকটা ক্রিকেট খেলার মতো। তবে এতে চার কোণায় চারজন এবং একজন বলিং ও একজন ব্যাটিংয়ে থাকে। বাদবাকি খেলাটা ক্রিকেটের মতোই। ক্রিকেট জনপ্রিয়তা পাবার পর এই খেলাটি হারিয়ে গেছে বাংলাদেশ থেকে।

নদীতে মাছ ধরার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমার বরশিতে মাছ ওঠে না। জাল ফেললেও মাছ ওঠে না। তাই আর মাছ ধরার চেষ্টা করি না। তবে বিকেলে নদীতে ঘের দিয়ে আমাদের গ্রামের জেলেরা মাছ ধরতো। সে এক দারুণ উত্তেজনাকর ব্যাপার। মাছগুলি লাফ দিয়ে অনেক উপড়ে উঠে যেত— চেষ্টা যদি পালিয়ে যেতে পারে একবার! আমি বসে বসে সেই দৃশ্য দেখতাম। আজকের কিশোররা এসব কিছুই দেখে না, উপভোগ করে না। তারা আইপ্যাড আর কমপিউটার গেমস নিয়ে ঘরের চার দেয়ালে নিজেদের শৈশব-কৈশোরের দুরন্ত সময়টাকে উপভোগ করতে পারছে না প্রকৃতির সঙ্গে। শৈশব-কৈশোর আর প্রকৃতি এসব ভিন্ন হতে পারে কিভাবে— আমি বুঝি না!