ধ্যান: মন নিয়ন্ত্রণের কৃৎকৌশল
পর্ব ১
তৌফিকুল ইসলাম পিয়াসপ্রকাশিত : এপ্রিল ১১, ২০২০
পঁচিশ বছর বয়সে মহানবি মুহাম্মদ (স.) আরবের ধনাঢ্য বিধবা ৪০ বছর বয়সী হযরত খাদিজাকে (রা.) বিয়ে করেন। খাদিজা (রা.) যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন মুহাম্মদ (সা.) দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। খাদিজার গর্ভেই মুহাম্মদের (সা.) একাধিক সন্তান জন্ম নিয়েছে। খাদিজাকে খুব ভালোবাসতেন মুহাম্মদ (সা.)।
খাদিজাকে (রা.) বিয়ের পর থেকেই মুহাম্মদ (সা.) ঐহিতাসিক হিরা পর্বতের একটা গুহায় বসে ধ্যান করতেন। তিনি চিন্তায় মশগুল থাকতেন। এভাবেই ৪০ বছর বয়সে তিনি নবুয়াত প্রাপ্ত হলেন। আধ্যাতিক লোকজনই মূলত ধ্যানে মগ্ন হন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধ্যান যে কেউই করতে পারে। ধ্যান মূলত একটা গভীর প্রাকটিস মাত্র। ধ্যানের মাধ্যমে যে-কোনো সাধনা করে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন সম্ভব।
আমি যখন ছোট, আমাদের গ্রামে একজন দাদি ছিলেন, আদু কাকার মা। কারো হাত বা পায়ে ব্যথা পেলে সবাই ওনার কাছে যেত। উনি কীসব দোয়া-দরুদ পড়ে একটা ম্যাসাজ করে, ফুঁ দিয়ে দিতেন এবং তাতেই ব্যথা ভালো হয়ে যেত। পরে জানলাম, কাঠপোড়া বাসি ছাই ব্যথা উপশমের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। আমি একদিন পায়ে ব্যথা পেয়ে সুযোগ পেয়ে গেলাম বিষয়টা পরীক্ষা করার। দেখলাম, উনি দোয়া-দরুদ পড়ছেন এবং বাসি ছাই দিয়ে আমার পা ম্যাসাজ করে দিলেন।
বিষয়টা এরকম, যে ব্যক্তি জানে যে বিদ্যুৎ কিভাবে উৎপন্ন হয়, পানির স্রোত দিয়ে বা পারমানবিক শক্তি দিয়ে কিংম্বা কয়লা পুড়িয়ে; কিভাবে ন্যাশনাল গ্রীডে সংযুক্ত হয়ে পরবর্তীতে ২২০ ভোল্টে পরিণত হয় এবং আপনার বাসার বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিকে ব্যবহার যোগ্য করে তোলে; সে ব্যক্তি যেমন ‘সুইচ’ টিপলেই বাতি জ্বলে ওঠে আবার আপনার বাসার কাজের লোকটি যে অতসত কিছু্ই বোঝে না সেও কিন্তু ওই সামান্য ‘সুইচ’ টিপে দিলেই বাতি জ্বলে ওঠে।
কলেজে পড়াকালীন সময় আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে কিছু পড়াশোনার সুযোগ হয়েছিল আমার। বেশ কয়েকটা ভালো বইও হাতে পেয়ে গেলাম। আধ্যাত্মিকতার বিষয়টা কিছু বুঝতে পারলাম। খুব উৎসাহ নিয়ে প্রাকটিস শুরু করলাম। অনেকগুলি বিষয়ই ততদিনে আমার মাথায় ঝট পেকে ছিল, যেমন: মসজিদের হুজুররা পানি পড়া দিলে অসুখ ভালো হয় কেন? আবার একই বিষয় ব্রাহ্মণরাও করে। কিন্তু তারা কোনও দোয়া দরুদ পড়ে না; তারা তাদের মন্ত্র পরে ফুঁ দেয়। সব ক্ষেত্রেই কাজ কিন্তু একই।
বিষয়গুলি আমাকে বরাবরই দ্বিধায় ফেলে দিত। আমি নিজেও কিছু চমৎকার দোয়া শিখে ফেলেছিলাম। খুব বেশি পেটে ব্যথা হলে আমি নিজেই ফুঁ দিয়ে সারিয়ে দিতে পারতাম। যে কারণে আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। জানলাম বিজ্ঞাননির্ভর যুক্তি। মানুষ মূলত তিনটি অবস্থায় থাকতে পারে অথবা মানুষের মনের তিনটি স্তর রয়েছে।
সচেতন, অচেতন এবং অবচেতন। আমরা যখন স্বাভাবিক অবস্থায় থাকি সেটাই সচেতন অবস্থা। যখন ঘুমে থাকি বা অজ্ঞান হয়ে যাই সেটাই অচেতন। কিন্তু মানব জীবনের সবচে কৌতুহলউদ্দীপক বিষয়টা হলো অবচেতন। আর এই অবচেতন মনের খেলাটাই হলো আসল মজা। এই অবচেতন মন থেকেই কোনও মানুষ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। অবচেতন মনে মানুষ তার নিজেকে, তার পারিপাশ্বিক অবস্থানের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেবার ক্ষমতা অর্জন করে। এমনকি এই অবচেতন মনের একটি বিশেষ অবস্থায় পৌঁছে অন্য মানুষকেও পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আপনি আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাটা অবচেতন মনে পৌঁছে করুন, সাফল্য অনিবার্য।
আমরা যে স্বপ্ন দেখি তা মূলত বিক্ষিপ্তভাবে দেখি। কিন্তু অনেক স্বপ্নই কখনো কখনো অনেকের জীবনেই বাস্তবে পরিণত হতে দেখা যায় বা ভবিষ্যতে মিলে যায়। অনেকে আবার স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতেও পারদর্শিতা দেখান। আসলে স্বপ্নগুলো শুধু স্বপ্নই। মানুষের অনেক বিষয়ই এখন অবধি ব্যাখ্যার অতীত। তারপরও মানুষ নিয়মিত গবেষণা করে যায়। আসলে স্বপ্ন কখনোই আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু আপনি চাইলেই স্বপ্নকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আর সেজন্যও আপনাকে অবচেতন মনে পৌঁছতে হবে।
অবচেতন মন মানে হলো ধ্যানাবস্থা। আপনাকে ধ্যান করা শিখতে হবে। গভীর ধ্যান। আপনার মনের সবচে গভীর স্তরে পৌঁছতে হবে আপনাকে। এটা একটা কঠিন প্রাকটিস। আমি এক সময় ধ্যান করা শুরু করে দিলাম। প্রতিদিন ভোড়ে আর রাতে ঘুমানোর পূর্বে। প্রায় এক ঘণ্টা করে অবচেতন মনের গভীরে নিয়ে যেতাম নিজেকে। এই কাজটা খুব গোপনে করতে হয়। আমিও তাই করতাম। মাসখানেক পর খুব আনন্দ পেয়ে গেলাম বিষয়টাতে। টানা প্রায় বছরখানেক আমি অবচেতন মনে পৌঁছে যেতাম। প্রথম প্রথম প্রায় বিশ পচিশ মিনিট লেগে যেত অবচেতন মনে পৌঁছতে। কিন্তু প্রাকটিস করতে করতে একটা সময় আসলো যখন দুই বা তিন মিনিটের মধ্যেই যে কোনো অবস্থায়ই পৌঁছে যেতে পারতাম।
অনেকগুলি মজার বিষয় আমি এর মধ্যে আয়ত্ব করে ফেললাম। সত্যি বলতে কি, আমার নিজের কাছেও বিষয়গুলি খুব বিব্রতকর মনে হতো। কিভাবে হচ্ছে? কিভাবে পারছি? যেমন, আমি এখনও যদি নির্দিষ্ট একটা সময়ে ঘুম থেকে উঠে যেতে চাই, আমার ঘুম ঠিক সেই সময়েই অটোমেটিকভাবে ভেঙে যাবে। আমার কোনও এলার্ম বা ঘড়ির প্রয়োজন হয় না। এটা একটা খুবই সহজ মানসিক ব্যায়াম।
কিন্তু এজন্য আপনাকে আগে মন নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে। একটা পর্যায়ে আমার কৌতূহল বাড়তে বাড়তে এর মাত্রাও ছাড়িয়ে যেতে থাকে। তখন ঢাকার নবাবগঞ্জে আমার অফিস। আমি তখন খুব সকালে আমার অফিসে পৌঁছতাম। আমার তখন কোনও পিয়ন ছিল না। নিজের অফিস নিজেকেই ঝাড়ু দিতে হতো, প্রতিদিনই দিতাম। অপরিচ্ছন্নতা আমার অপছন্দ। আমার তৎকালীন অফিসের অপজিটে নবাবগঞ্জ পোস্ট অফিস। এর মধ্যে একদিন সকাল ১০টা দিকে আমি আমার অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখলাম অসম্ভব রূপবতী একটা মেয়ে পোস্ট অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার মাথায় একটা বদমায়েসি চিন্তা ভর করলো।
ভাবলাম, আজ আমার মনের ক্ষমতা একটু পরীক্ষা করে দেখবো। আমি মুহূর্তে ধ্যানে চলে গেলাম। এবং ওই মেয়েটাকে আমার অফিসে আসার নির্দেশ দিতে থাকলাম। আমার বিশ্বাস ছিল আমার ধ্যানের প্রতি। কিন্তু একপর্যায়ে দেখলাম, মেয়েটা চলে যাচ্ছে। আমি নিজেকে ক্ষমতাকে নিয়ে নিজে নিজেই মজা করলাম। ভাবলাম আসলে সব কিছু সম্ভব নয় মনের শক্তি দিয়ে অর্জন করা।
অফিসে গিয়ে বসে পেপার দেখছি। আমার অফিসটা দোতালায়। ওহ, আমার ওটা ছিল একটা কমপিউটার ট্রেনিং স্কুল। মিনিট বিশেক পর হঠাৎ আমি আবিষ্কার করলাম, কোনও একটা মেয়ে আমার অফিসে উঠছে। আমি ছেলেদের এবং মেয়েদের হাঁটার শব্দের পার্থক্য বুঝি। চিন্তা করলাম, সেই মেয়েটা না তো? এবং হ্যাঁ। সেই মেয়েটাই আমার অফিসে চলে এসেছে। আমি জীবনে শুধু ওই একদিনই কোনও মেয়েকে দেখে আমার হাত-পা কাঁপতে দেখেছি। মেয়েটার জন্য নয়, আমার মনের ক্ষমতার বিজয়ে। চলবে
























