পলাশির যুদ্ধ

পলাশির যুদ্ধ

নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশির যুদ্ধ’

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২০

কবি নবীনচন্দ্র সেনের আজ জন্মদিন। চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার অন্তর্গত পশ্চিম গুজরার (নোয়াপাড়া) সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীন জমিদার পরিবারে ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার রচিত ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কবিতা নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখিত রিভিউটি ‘বঙ্গদর্শন’ থেকে ছাড়পত্রে পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

পলাশির যুদ্ধ ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত। এবং পলাশির যুদ্ধে অনৈতিহাসিক বৃত্তান্ত। কেননা ইহার প্রকৃত ইতিহাস লিখিত হয় নাই। সুতরাং কাব্যকারের ইহাতে বিশেষ অধিকার। এই জন্যই বোধ হয়, মেকলে ক্লাইবের জীবনচরিত নামক উপন্যাস লিখিয়াছেন। যাহা হউক, মেকলের সঙ্গে আমাদের এক্ষণে কার্য নাই; নবীন বাবুর গ্রন্থের কথা বলি।

মেঘনাদবধ বা বৃত্রসংহারের সহিত এই কাব্যের তুলনা করিতে চেষ্টা পাইলে, কবির প্রতি অবিচার করা হয়। ঐ কাব্যদ্বয়ের ঘটনা সকল কাল্পনিক, অতি প্রাচীন কালে ঘটিয়াছিল বলিয়া কল্পিত এবং সুরাসুর রাক্ষস, বা অমানুষিক শক্তিধর মনুষ্যগণ কর্তৃক সম্পাদিত; সুতরাং কবি সে ক্ষেত্রে যথেচ্ছক্রমে বিচরণ করিয়া, আপনার অভিলাষ মত সৃষ্টি করিতে পারেন।

পলাশির যুদ্ধে ঘটনা ঐতিহাসিক, আধুনিক; এবং আমাদিগের মত সামান্য মনুষ্যকর্তৃক সম্পাদিত। সুতরাং কবি এস্থলে, শৃঙ্খলাবদ্ধ পক্ষীর ন্যায় পৃথিবীতে বদ্ধ, আকাশে উঠিয়া গান করিতে পারেন না। অতএব কাব্যের বিষয়-নির্বাচন সম্বন্ধে নবীন বাবুকে সৌভাগ্যশালী বলিতে পারি না।

তবে এই কাব্যমধ্যে ঘটনাবৈচিত্র্য, সৃষ্টিবৈচিত্র্য, সঙ্ঘটন করা কবির সাধ্য বটে। তৎসম্বন্ধে নবীন বাবু তাদৃশ্য শক্তিপ্রকাশ করেন না। বৃত্রসংহারের একটি বিশেষ গুণ এই যে, সেই একখানি কাব্যে উৎকৃষ্ট উপাখ্যান আছে, এবং গীতিকাব্য আছে। পলাশীর যুদ্ধে, উপাখ্যান এবং নাটকের ভাগ অতি অল্প—গীতি অতি প্রবল। নবীন বাবু বর্ণনা এবং গীতিতে এক প্রকার মন্ত্রসিদ্ধ। সেই জন্য পলাশীর যুদ্ধ এত মনোহর হইয়াছে।

এই সকল বিষয়ে তাঁহার লিপিপ্রণালীর সঙ্গে বাইরণের লিপিপ্রণালীর বিশেষ সাদৃশ্য দেখা যায়। চরিত্রের আশ্লেষণে দুই জনের এক জনও শক্তি প্রকাশ করেন না।—বিশ্লেষণে দুই জনেরই কিছু শক্তি আছে। নাটকের যাহা প্রাণ—হৃদয়ে হৃদয়ে ‘ঘাত প্রতিঘাত’—দুই জনের এক জনের কাব্যে তাহার কিছুমাত্র নাই। কিন্তু অন্য দিকে দুই জনেই শক্তিশালী। ইংরেজিতে বাইরণের কবিতা তীব্রতেজস্বিনী, জ্বালাময়ী, অগ্নিতুল্যা।

বাঙ্গালাতেও নবীন বাবুর কবিতা সেইরূপ তীব্রতেজস্বিনী, জ্বালাময়ী, অগ্নিতুল্যা। তাঁহাদিগের হৃদয়নিরুদ্ধ ভাব সকল আগ্নেয়গিরিনিরুদ্ধ, অগ্নিশিখাবৎ—যখন ছুটে, তখন তাহার বেগ অসহ্য। বাইরণ স্বয়ং এক স্থানে কোন নায়কের প্রণয়বেগ বর্ণনাচ্ছলে নায়ককে যাহা বলাইয়াছেন, তাঁহার নিজের কবিতার বেগ এবং নবীন বাবুর কবিতার বেগ সম্বন্ধে তাহাই বলা যাইতে পারে।

But mine was like the lava flood
That boils in Etna’s breast of flame.
I cannot prate in pulling strain
of ladye-love and beauty’s chain :
If changing cheek and scorching vein,
Lips taught to writhe but not complain,
If bursting heart, and madd’ning brain,
And daring deed and vengeful steel
And all that I have felt and feel,
Betoken love, that love was mine,
And shown by many a bitter sign.

নবীন বাবুরও যখন স্বদেশবাৎসল্য স্রোতঃ উচ্ছলিত হয়, তখন তিনিও রাখিয়া ঢাকিয়া বলিতে জানেন না। সেও গৈরিক নিস্রবের ন্যায়। যদি উচ্চৈঃস্বরে রোদন, যদি আন্তরিক মর্মভেদী কাতরোক্তি, যদি ভয়শূন্য তেজোময় সত্যপ্রিয়তা, যদি দুর্বাসাপ্রার্থিত ক্রোধ, দেশবাৎসল্যের লক্ষণ হয়—তবে সেই দেশবাৎসল্য নবীন বাবুর, এবং তাহার অনেক লক্ষণ এই কাব্যমধ্যে বিকীর্ণ হইয়াছে।

বাইরণের ন্যায় নবীন বাবু বর্ণনায় অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। বাইরণের ন্যায়, তাঁহারও শক্তি আছে যে, দুই চারিটি কথায়, তিনি উৎকৃষ্ট বর্ণনার অবতারণ করিতে পারেন। ক্লাইবের নৌকারোহণ ইহার দৃষ্টান্তস্থল। কিন্তু অনেক সময়েই, নবীন বাবু সে প্রথা পরিত্যাগ করিয়া, বর্ণনায় অনর্থক কালহরণ করেন।

যাহাই হউক, কবিদিগের মধ্যে নবীন বাবুকে আমরা অধিকতর উচ্চ আসন দিতে পারি না পারি, তাঁহাকে বাঙ্গালার বাইরণ বলিয়া পরিচিত করিতে পারি। এ প্রশংসা বড় অল্প প্রশংসা নহে। পলাশির যুদ্ধ যে বাঙ্গালার সাহিত্যভাণ্ডারে একটি বহুমূল্য রত্ন তদ্বিষয়ে সংশয় নাই।

উপসংহারকালে, পাঠকদিগকে আমরা একটি কথা বলিব। পলাশির যুদ্ধের আমরা রাখিয়া ঢাকিয়া পরিচয় দিয়াছি। যদি তাঁহারা ইহার যথার্থ পরিচয় লইতে ইচ্ছা করেন, আদ্যোপান্ত স্বয়ং পাঠ করিবেন। যে বাঙ্গালি হইয়া বাঙ্গালির আন্তরিক রোদন না পড়িল, তাহার বাঙ্গালি জন্ম বৃথা।

আমরা এরূপ ব্যঙ্গ করিতে বড় ভয় পাই। সময়ে সময়ে এরূপ ব্যঙ্গ করিয়া, আমরা বড় অপ্রতিভ হই। এদেশীয় পাঠকেরা সচরাচর, পিতৃ মাতৃ উচ্চারণ করিয়া অথবা মূর্খ, পাপিষ্ট, নরাধম বলিয়া কাহাকে গালি দিলে, বুঝিতে পারেন যে একটা রহস্য হইল বটে, তদ্ভিন্ন অন্য কোন প্রকারে যে ব্যঙ্গ হইতে পারে, ইহা আমরা সকলে বড় বুঝিতে পারি না। যে সকল ইংরেজ সমালোচক, যাহা কিছু আর্য সাহিত্যে, আর্য দর্শনে, আর্য ভাস্কর্যে বা আর্য বিজ্ঞানে উৎকৃষ্ট দেখেন, তাহাই ইউরোপ হইতে নীত মনে করেন, তাঁহাদিগকে ব্যঙ্গ করিবার জন্য, এবং যে সকল দেশী সমালোচক যেখানে সাদৃশ্য দেখেন, সেইখানে চুরি মনে করেন, তাঁহাদিগকে ব্যঙ্গ করিবার জন্য, আমরা সেবার লিখিয়াছিলাম যে, শকুন্তলা মিরন্দার যেখানে সাদৃশ্য আছে, সেখানে অবশ্য শেক্সপীয়র হইতে কালিদাস চুরি করিয়াছেন।

ইহা পাঠ করিয়া অনেকেই ব্যতিব্যস্ত! কি সর্বনাশ! কালিদাস শেক্সপীয়রের পরবর্তী! আর একখানি গ্রন্থ সমালোচনাকালে, লেখক যে সকল পচা পুরাতন চর্বিত চর্বিত পুনশ্চর্বিত তত্ত্ব লিখিয়াছিলেন, তাহার দুই একটি উদাহরণ উদ্ধৃত করিয়া, অতিশয় অভিনব বলিয়া পাঠককে উপঢৌকন দিয়াছিলাম। পড়িয়া লেখক বিষাদসাগরে নিমগ্ন হইয়া, রোদন করিয়া বলিলেন, “আমার লিখিত বিষয় সকলের নবীনত্ব আছে বলিয়া বঙ্গদর্শন আমাকে গালি দিয়াছে!” কি দু:খ!

এই স্থানে ক্লাইবের জীবনচরিতকে উপন্যাস গ্রন্থ বলিলাম দেখিয়া, এই সকল পাঠকগণ উপরিকথিত প্রথানুসারে তাহার অর্থ বুঝিতে পারেন। তাঁহাদিগকে বুঝাইবার জন্য বলিয়া রাখা ভাল যে, কতকগুলি বাঙ্গালা সম্বাদপত্র যেরূপ উপন্যাস, এও সেইরূপ উপন্যাস।

‘বঙ্গদর্শন’, কার্তিক ১২৮২, পৃ. ৩১৯-২৭