নাট্যচর্চা কো‌নো সস্তা তামাশা নয়

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৯

নাট্যচর্চা কর‌তে হ‌লে কেবলমাত্র ক‌য়েকটা নাটক পড়‌লে হয় না। দুটা নাট‌কে অভিনয় কর‌লেই নাট্যচর্চা হয় না। নাট্যচর্চা অনেক বৃহৎ কর্ম। বিশেষ ক‌রে বর্তমান সম‌য়ে নাট্যচর্চা কর‌তে হ‌লে, নাটক সম্প‌র্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ কর‌তে বা নাট্য বি‌শেষজ্ঞ হ‌তে হলে ইতিহাস, সমাজ‌বিজ্ঞান, রাজনী‌তি, দর্শন বহু‌কিছু বুঝ‌তে হয়। বিশ শত‌কের সব‌চে‌য়ে আলোচিত নাট্যকার, নাট্য নি‌র্দেশক এবং নাট্যতা‌ত্ত্বিক ব্রেশট ‘মান ইস্ট মান’ নাটক লেখার আগে গভীরভা‌বে মার্কসবাদ অধ্যায়ন শুরু ক‌রেন। পুঁজি গ্রন্থ‌টি পাঠ ক‌রে তি‌নি জগৎকে নতুনভা‌বে বি‌শ্লেষণ কর‌তে শে‌খেন। মার্কসবাদ পাঠ করার আগপর্যন্ত তি‌নি বহু‌কিছু ব্যাখ্যা কর‌তে ব্যর্থ হ‌য়ে‌ছি‌লেন। মার্কসবাদ আর অন্যান্য নানাধর‌নের পড়াশুনার মধ্য দি‌য়েই তি‌নি তাঁর সব‌চে‌য়ে আলোচিত নাটকগু‌লি লি‌খে‌ছি‌লেন।

তি‌নি পরবর্তীকা‌লে ব‌লে‌ছি‌লেন, য‌দি মার্কসবাদ সম্প‌র্কে আপনার আগ্রহ না থা‌কে তাহ‌লে আমার নাট‌কে হাত দে‌বেন না। ব্রেশট ম‌নে কর‌তেন, মার্কসবাদ না বুঝ‌লে তাঁর নাটকগুলি নি‌র্দেশনা দেয়া যায় না। নাট‌কের ভিত‌রের মূল বক্তব্যকে স্পষ্ট ক‌রে তোলা যায় না। কথাটা ব্রেশট যে স‌ঠিক ব‌লে‌ছি‌লেন, বহুবার তা প্রমা‌ণিত হ‌য়ে‌ছে। মার্কসবা‌দে আগ্রহ নেই এমন নি‌র্দেশকরা যখন তাঁর নাটক নি‌র্দেশনা দি‌তে গে‌ছেন, তাঁর নাট‌কের মূল বক্তব্য ফু‌টি‌য়ে তুল‌তে ব্যর্থ হ‌য়ে‌ছেন। বাংলা তথা‌ ভারতীয় নাট‌কের আরেক দিকপাল উৎপল দত্ত একই কথা ব‌লে‌ছেন, মার্কসবাদ বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ না বু‌ঝে বর্তমান যু‌গে মহৎ নাটক লেখা যায় না। ইতিহাস, সমাজ‌বিজ্ঞান, দর্শন সম্প‌র্কে ধারণা না থাক‌লে দ্বা‌ন্দ্বিক বস্তুবাদ বোঝা যায় না। কথাটা হ‌লো, যারা সর্বযু‌গে পৃ‌থিবীর সব‌চে‌য়ে আলোচিত নাট্যকার, সক‌লের নাট‌কে র‌য়ে‌ছে গভীর প্রজ্ঞার প্রকাশ। র‌য়ে‌ছে ইতিহাস, সমাজ সম্প‌র্কে নানারকম ব্যাখ্যা বি‌শ্লেষণ।

নাট্যচর্চা তাই খুব সহজ বিষয় নয়। নাটক লেখা, নাটক নি‌র্দেশনা, নাট‌কে অভিনয় বা নাটক সম্প‌র্কে কিছু লিখ‌তে হ‌লে সা‌হিত্য, ইতিহাস, সমাজ‌বিজ্ঞান সম্প‌র্কে গভীর জ্ঞান থাকা দরকার। নাট‌কের স‌ঙ্গে যুক্ত বহু মানুষ র‌য়ে‌ছে, কিন্তু গত তিনহাজার বছ‌রে নাট্যকার জ‌ন্মে‌ছে সে তুলনায় কম, হা‌তে গোনা ক‌য়েকজন। কিন্তু এ সময়কা‌লে প্রচুর নাম করা অভিনেতা-অভিনেত্রীর নাম পাওয়া যা‌বে সারা‌বি‌শ্বের দেশগুলি‌তে। ‌কিন্তু মহৎ নাট্যকার পাওয়া যা‌বে কয়জন? সারা‌দে‌শের হি‌সে‌বে গ‌ড়ে একজন পাওয়া যা‌বে না। পঞ্চাশজন বিশ্বমা‌নের নাট্যকা‌রের তা‌লিকা তৈ‌রি করা খুব ক‌ঠিন হ‌য়ে দাঁড়া‌বে। কিন্তু উপন্যা‌সিক পাওয়া যা‌বে অনেক। কিন্তু নাটক অনেক প্রাচীন সা‌হিত্য আর গদ্যসা‌হিত্য বা উপন্যাস লেখা আরম্ভ হ‌য়ে‌ছে মাত্র পাঁচ সাত‌শো বছর আগে। তিনহাজার বছ‌রে ক’জন নাট্যকার পাওয়া যা‌চ্ছে যা‌দের নাম বারবার উচ্চা‌রিত হয়!

নাটক এক বড়মা‌পের কর্ম। প্রবাদ র‌য়ে‌ছে, নাট‌কেই সমা‌জের চিত্র দ্রুত প্রকা‌শ পায়, সর্বদা বি‌দ্রোহ ঘো‌ষিত হয় নাট‌কে। নাট‌কের চ‌রিত্ররা সমা‌জের কা‌রো না প্রতিনিধিত্ব করে। কথাগু‌লি বলা হ‌চ্ছে বিশ্বমা‌নের নাটক সম্প‌র্কে। নাট‌কের ম‌ধ্যে সমা‌জের দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকা‌শিত হয় যে, নাটক‌কে বলা হয় সমা‌জের দর্পন। আর পৃ‌থিবীর বড় বড় সা‌হি‌ত্যিকরা বারবার নাটক থে‌কে উদাহরণ দেয়, আর নাট‌কের সংলাপ উদ্ধৃত ক‌রে নি‌জেদের রচনায়। বিশ্বের একজন মহান ব্যক্তিত্ব কার্ল মার্কস, তি‌নি কিছু লিখ‌তে বসবার আগে বারবার ধ্রুপদী নাটকগুলি পড়‌তেন। শেক্স‌পিয়া‌রের বহু নাট‌কের সংলাপ মার্কস মার্ক‌সের প‌রিবা‌রের সদস্যদের মুখস্থ ছি‌লে। মার্কস শুধুমাত্র প্রাচীন গ্রী‌সের নাটকগুলি মূল ভাষায় পাঠ করবার জন্য গ্রীকভাষা শি‌খে‌ছি‌লেন। ফ‌লে নাট‌কের শ‌ক্তিটা বোঝা যায় এ থে‌কে।

সারা‌বি‌শ্বে নাটক হ‌চ্ছে বড় মা‌পের সা‌হিত্য, শুধুমাত্র মঞ্চায়নের ব্যাপার নয়। নাটক পাঠ করবারও ব্যাপার। নাটক পাঠ না করে পাশ্চা‌ত্যে সা‌হিত্য পাঠ সম্পূর্ণ হয় না। য‌দিও আমাদের এখা‌নে ম‌নে করা হয়, নাটক মঞ্চায়‌নের ব্যাপার; পাঠ করবার ব্যাপার না। কারণ পাঠ করবার ম‌তো নাটক লেখা, নাটক‌কে উঁচু মা‌নের সা‌হিত্য হি‌সে‌বে সৃ‌ষ্টি করা তত সহজ নয়। বরং ক‌ঠিন কাজ। আর বড় মা‌পের সা‌হিত্য না হ‌লে মানুষ তা ম‌নো‌যোগ দি‌য়ে পাঠ কর‌বে কেন? বড় মা‌পের সা‌হিত্য সৃ‌ষ্টি কর‌তে হ‌লে বড় মা‌পের প্রজ্ঞা দরকার। নাটক লেখার জন্য দরকার বি‌বিধ বিষ‌য়ে জ্ঞান। নাটক কো‌নো সস্তা ব্যাপার নয়, সামান্য তামাশা নয়। য‌দি নি‌জে‌দের মূর্খতা‌কে পুঁজি ক‌রে, ভয়বহ অহং‌বোধ নি‌য়ে আমরা অনেকে সেটা‌কে সস্তা তামাশা বা‌নি‌য়ে ফে‌লে‌ছি। কিন্তু তা স‌ত্ত্বেও কিছু কিছু বড় মা‌পের কাজ হ‌চ্ছে।