পতঙ্গবিশারদ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের আজ মৃত্যুদিন

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৮, ২০২১

পতঙ্গবিশারদ ও উদ্ভিদবিদ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের আজ মৃত্যুদিন। ১৯৮১ সালের ৮ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৯৫ সালের ১ আগস্ট ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত লোনসিং গ্রামে তার জন্ম।

পিতা অম্বিকাচরণ ভট্টাচার্য গ্রাম্য পুরোহিত ও মাতা শশীমুখী দেবী গৃহবধু ছিলেন। গোপালচন্দ্রের পাঁচ বছর বয়সে অম্বিকাচরণ মৃত্যুবরণ করলে দারিদ্র্যে মধ্যে তার শৈশব অতিবাহিত হয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করার পর গোপালচন্দ্র যখন ১৯১৩ সালে কলেজে আইএ পড়ার জন্য ভর্তি হলেও অর্থের অভাবে তার পাঠ্যক্রম শেষ করা হয়ে ওঠেনি।

এরপর তিনি একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি সাহিত্যচর্চায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন এবং পালা গান ও জরি গানে ইত্যাদি লোকগীতির জন্য গান রচনা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন হাতে লেখা পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন।

১৯১৮ সালে প্রবাসী পত্রিকায় একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে টেলিফোন অপারেটর হিসেবে কাজ করার সময় প্রবাসী পত্রিকায় জৈবদ্যুতি নামক তার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে তা জগদীশচন্দ্র বসুর নজরে আসে। জগদীশচন্দ্র তাকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দিরে মেরামতির কাজে নিযুক্ত করেন। এই প্রতিষ্ঠানে থেকেই তিনি জীববিদ্যার ওপর গবেষণা শুরু করেন।

১৯৩২ সালে প্রথম উদ্ভিদের জীবনের ওপর তার গবেষণা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয়। এরপর জৈব-আলোকবিদ্যার ওপর তার বিভিন্ন গবেষণা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও ধীরে ধীরে কীটপতঙ্গের ওপর তার আগ্রহ জন্ম নেয়। এই সময় তিনি আলোকচিত্রগ্রাহক হিসেবে দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং পিঁপড়ে, মাকড়শা, ব্যাঙাচি, বাদুড় প্রভৃতি প্রাণীর আলোকচিত্র তুলতে শুরু করেন।

১৯৪০ সালে বোস ইসস্টিটিউটের পত্রিকায় তিনি দেখান যে, পিঁপড়ে ও মৌমাছির মতো সামাজিক কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে কিভাবে রাণী লার্ভার খাদ্যের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সঠিকভাবে পরিবর্তন করে অন্য রাণী, কর্মী ও সৈনিক পতঙ্গ সৃষ্টি করে। পিঁপড়ের জন্য স্বচ্ছ বাসা বানিয়ে চুপচাপ নিরীক্ষণ করে তিনি এই পর্য্যবেক্ষণ করেন। পতঙ্গদের প্রাকৃতিক বস্তুর ব্যবহারের ওপরও তার গবেষণা নিবদ্ধ হয়।

তিনি লক্ষ্য করেন, কিভাবে শিকারি বোলতা তাদের বাসার মুখ বন্ধ করার জন্য ছোট ছোট পাথরের টুকরো ব্যবহার করে থাকে। প্রজননকালে ঘুরঘুরে পোকা কিভাবে শিকারিদের আক্রমণ থেকে তার ডিমগুলিকে রক্ষা করার জন্য পেছনের পা দিয়ে কাদার তৈরি গোলক নির্মাণ করে। এছাড়া ব্যাঙাচি থেকে পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙে পরিবর্তনের সময় কিছু ব্যাক্টেরিয়ার উপকারিতা সম্বন্ধেও তিনি গবেষণা করেন।

ব্যাঙাচির ওপর পেনিসিলিন ওষুধ প্রয়োগ করে তিনি লক্ষ্য করেন যে, সেগুলি পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙে পরিবর্তিত হতে সক্ষম হয় না, বরং পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙাচিতে রূপান্তরিত হয়। তার প্রায় বাইশটি গবেষণাপত্র ন্যাচারাল হিস্ট্রিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫১ সালে ভারতীয় সামজিক কীটপতঙ্গের ওপর তার গবেষণা সম্বন্ধে বক্তৃতা দেয়ার জন্য প্যারিসের ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য স্টাডি অব সোশ্যাল ইন্সেক্টস নামক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি ডাক পান। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার জন্য তাকে বিভিন্ন সময়ে বৈষম্যের শিকার হতে হয়।

১৯৪৮ সালে গোপালচন্দ্র সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেন। পুলিন বিহারী দাসের সঙ্গে তিনি অক্লান্ত ভাবে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কর্মকাণ্ডে শ্রম দেন। ১৯৫০ সালে তিনি জ্ঞান ও বিজ্ঞান নামক বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এছাড়া তিনি ভারতকোষ নামক বাংলা ভাষার একটি বিশ্বকোষ রচনাতেও সহযোগিতা করেন।

এ পর্যন্ত গোপালচন্দ্রের ১৬ প্রকাশিত বইয়ের নাম জানা যায়। এছাড়া তার বহু লেখা অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য স্মরণ সংখ্যার তথ্যমতে, তার লেখার সংখ্যা হাজার খানেকের মতো। যার সবকিছু এখন আর উদ্ধার করা সম্ভব নয়।

বইগুলো হচ্ছে, আধুনিক আবিষ্কার, বাংলার মাকড়সা (১৯৪৯), করে দেখো (১ম খণ্ড ১৯৫৩, ২য় খণ্ড ১৯৫৬), আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু (১৯৭৬), বাঙলার কীটপতঙ্গ (১৯৭৫), মনে পড়ে (আত্মজীবনী- ১৯৭৭), পশুপাখি কীটপতঙ্গ (১৯৮২), বিজ্ঞানের আকস্মিক আবিষ্কার (১৯৮৪), বাঙলার গাছপালা (১৯৮৬), বিজ্ঞান অমনিবাস (১৯৮৭), জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা খবর, বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান সংবাদ, মানব কল্যাণে পারমাণবিক শক্তি, আণবিক বোমা (অনুবাদ গ্রন্থ), মহাশূন্যে অভিযান (১৯৫৮) ও জীববিজ্ঞান (পাঠ্যপুস্তক)।

গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৯৬৮ সালে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৭৫ সালে বাংলার কীটপতঙ্গ নামক গ্রন্থ রচনার জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮১ সালে মৃত্যুর তিন মাস আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে। ২০০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে অবদানের জন্য গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার প্রচলন করে।