প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

পর্দা এবং জ্ঞানার্জনের ভারসাম্য

আরিফুল ইসলাম

প্রকাশিত : মার্চ ১৭, ২০২০

রাসুলের যুগে নারীরা মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়তেন। অন্ধকারের মধ্যে তারা মসজিদে যেতেন, আবার চারদিক আলোকিত হবার আগেই বাড়ি ফিরতেন। কেউ তাদেরকে দেখে চিনতে পারতো না। এমনকি অন্ধকারে নারীরা একজন আরেকজনকে চিনতে পারতেন না। (সহিহ বোখারি: ৩৭২, ৮৭২)

ইসলামের স্বর্ণযুগের নারীদের জ্ঞানের প্রতি ডেডিকেশন ছিল ঈর্ষনীয়। জ্ঞানার্জনে তাদের আগ্রহ কোনো অংশে কম ছিল না। একবার কয়েকজন নারী এসে রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে অভিযোগ করেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, (জ্ঞানার্জনের জন্য) পুরুষরা আপনার কাছে আমাদের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। আপনি আমাদের (জ্ঞানার্জনের) জন্য একটি দিন নির্ধারণ করে দিন।’

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নারীদের জন্য একটি বিশেষ দিন নির্ধারণ করেন। সেদিন তিনি তাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে নসিহত করেন, নির্দেশ দেন। (সহিহ বোখারি: ১০১) আবু হুরাইরা এবং আনাস ইবনে মালিকের (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) পর সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনা করেন আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)। তিনি রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রায় দুই হাজার হাদিস বর্ণনা করেন।

রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রী হিশেবে আয়েশার (রা.) এত বেশি হাদিস বর্ণনা করা উরওয়ার (রাহিমাহুল্লাহ) কাছে খুব একটা বিস্ময়কর ছিল না। উরওয়া (রা.) ছিলেন আয়েশার (রাঃ) বোনপো, আসমা বিনতে আবু বকরের (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ছেলে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে আয়েশার (রা.) জ্ঞান দেখে উরওয়া অবাক হন। তিনি খালাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই জ্ঞান আপনি কিভাবে অর্জন করলেন?’ আয়েশা (রা.) বললেন, ‘আমি কিংবা অন্য কোনো লোক অসুস্থ হলে যে ওষুধ ও প্রেসকিপশন দেয়া হয়, সেখান থেকে শিখেছি। তাছাড়া একজন আরেকজনকে যেসব রোগ ও ওষুধের কথা বলে আমি তাও মনে রেখেছি।’ (সিয়ারু আ`লাম আন-নুবালা ২/১৮২-১৮৩)

আবু বকরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) মেয়ে, রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রী এই পরিচয়গুলো আয়েশাকে (রা.) অহংকারী করেনি। এই পরিচয়গুলো তার জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়নি। তিনি জ্ঞানার্জন করেন এবং তার জ্ঞান থেকে মুসলিম উম্মাহ উপকৃত হয়। একজন সাধারণ মুসলিম নারী হিশেবে তিনি পর্দা করতেন। উম্মুল মু`মিনীন হিশেবে স্পেশাল পর্দা করতেন। পুরুষ সাহাবিরা সরাসরি তার এক্সেস পেতেন না। আয়েশার (রা.) থেকে হাদিস বর্ণনা করেন তার বোনপো উরওয়া ইবনে যুবাইর। তিনি সরাসরি খালার রুমে ঢুকতে পারতেন, খালার কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করতে পারতেন।

আয়েশার (রা.) আরেকজন ছাত্রী ছিলেন। তার নাম আমরাহ বিনতে আব্দুর রহমান (রা.)। রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনেকগুলো হাদিস তিনি বর্ণনা করেন। তিনি ছিলেন ইমাম মালিকের (রা.) শিক্ষিকা। খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রা.) শিহাব আয যুহরিকে হাদিস সংকলনের নির্দেশ দেবার সময় বলেন, ‘প্রথমে যাও আমরাহ`র কাছে। তার হাদিসগুলো আগে সংগ্রহ করো।’

একবার মদিনার বিচারক একটা রায় দিলে আমরাহ (রা.) তার শিক্ষার্থীদেরকে বলে দেন, ‘যাও, বিচারককে গিয়ে বলো এই রায়টি ভুল।’ বিচারক যখন শুনলেন তার রায়ের ভুল ধরেছেন আমরাহ (রা.), তখন সাথে সাথে আমরাহ`র (রা.) রায় মেনে নেন। মদিনার সাত ফুকাহার একজন ছিলেন সাইদ ইবনুল মুসাইয়িব (রা.)। একদিন দেখলেন তার ক্লাসের এক ছাত্রের মন খারাপ। ছাত্রের নাম ছিল আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লাহকে সাইদ (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে তোমার?’ আব্দুল্লাহ বললেন, ‘আজ আমার স্ত্রী ইন্তেকাল করেছেন। এজন্য আমার মন খারাপ।’

স্ত্রী ইন্তেকাল করেছে, তারপরও ছাত্রটি ক্লাস মিস দিচ্ছে না? ছাত্রের জ্ঞানার্জনের প্রতি এমন ডেডিকেশন দেখে সাইয়্যিদ (রা.) ওইদিনই নিজের মেয়ের সাথে আব্দুল্লাহর বিয়ে দেন। আগেরদিন স্ত্রী ইন্তেকাল করেছেন, তবুও আব্দুল্লাহ ক্লাসে যান। পরদিন নতুন স্ত্রীকে রেখে আবার ক্লাসে যেতে চাইলেন। আগেরদিন যিনি শিক্ষক ছিলেন, এখন তিনি শ্বশুর। আব্দুল্লাহ শ্বশুরের ক্লাসে যেতে চাইলে স্ত্রী বাধা দেন। স্ত্রী তাকে বললেন, ‘বসো, আমার বাবার কাছে গিয়ে যা শিখতে চাচ্ছ, সেটা আমার কাছ থেকে শিখে নাও। আমি আমার বাবার ইলম অর্জন করেছি।’

নবম শতাব্দীর একজন নারী জ্ঞানার্জনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার নাম ছিল ফাতিমা বিনতে ইয়াহিয়া (রা.)। ইমাম আশ-শাওকানী (রা.) তার সম্পর্কে বলেন, ‘ফাতিমা ইলমের দিক থেকে এতটাই পারদর্শী ছিলেন, তার বাবা ইয়াহিয়ার সাথে তিনি বিভিন্ন মাস`আলা নিয়ে বিতর্ক করতেন। মেয়ের জ্ঞান-প্রজ্ঞা দেখে তার আলেম বাবা স্বীকৃতি দেন, এই মেয়ের ইজতিহাদ করার সক্ষমতা আছে।’ তার বাবা তাকে বিয়ে দেন আল-মুতাছার ইবনে মুহাম্মদের (রা.) সাথে। তিনিও ছিলেন একজন আলেম। মাঝেমধ্যে ছাত্রদের বিভিন্ন জটিল মাস`আলা নিয়ে আলোচনা করতেন। আলোচনা শেষে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারলে ঘরের ভেতর যেতেন। ফিরে এসে মাস`আলার সমাধান বলতেন।

ছাত্ররা মজা করে বলতো, ‘এই মাস`আলা তো আপনার থেকে আসেনি, ঘরের ভেতর থেকে এসেছে।’ অর্থাৎ আল-মুতাছার ইবনে মুহাম্মদ স্ত্রী ফাতিমা বিনতে ইয়াহিয়ার কাছ থেকে মাস`আলা জেনে আসতেন। (Al-Muhadditath, Page 144)

মাজহাবের চার ইমামের সবার বাবা বাল্যকালে ইন্তেকাল করেন। জ্ঞানার্জনের প্রতি তাদেরকে আগ্রহী বানান তাদের মা। ইমাম আশ-শাফে`ঈর (রা.) মা তো জেরুজালেম থেকে ছেলেকে কোলে করে মক্কায় নিয়ে যান যাতে ছেলেটা মক্কার আলিমদের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করতে পারে। ইমাম মালিক (রা.) ছোটবেলায় গায়ক হতে চেয়েছিলেন। ছেলেকে গায়ক হবার ব্যাপারে নিরুৎসাহি করে জ্ঞানের প্রতি উৎসাহী করেন তার মা। কোন শিক্ষকের কাছে গিয়ে কী শিখবে সেই গাইডলাইন তার মা তাকে দেন।

ছোটবেলায় ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের (রা.) মা তাকে ভোরবেলায় মসজিদে নিয়ে যেতেন, আর দিনশেষে মসজিদ থেকে নিয়ে আসতেন। এইসব মহিয়সী নারীদের আত্মত্যাগের ফলে ইতিহাসে তাদের সন্তানরা `ইমাম` হয়ে আছেন।

ইসলামের স্বর্ণযুগে নারীরা পর্দার ব্যাপারে যেমন কনসার্ন ছিলেন, তেমনি জ্ঞানার্জনের ব্যাপারেও কমিটেড ছিলেন। পর্দার প্রশ্ন তাদের জ্ঞানার্জনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আবার পর্দাকে জলাঞ্জলি দিয়ে তার জ্ঞানার্জনে অগ্রসর হননি। এই দুটোকে ব্যালেন্স করে চলেছেন। স্বর্ণযুগের নারীরা জ্ঞানার্জনের বেলায় হীনমন্যতায় ভুগতেন না। পর্দা পালন করেও কিভাবে শেখা যায়, শেখানো যায় তার উদাহরণ তারা রেখে গেছেন।

জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণের জন্য রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যুগের নারীরা রাসূলের দ্বারস্থ হয়েছেন। রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছ থেকে শেখার আগ্রহ জানিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের উৎসাহে পানি ঢালেননি। তিনিও তাদের জানার আগ্রহকে সমর্থন জানিয়েছেন। সমাজের একটা অংশ যদি ইলম বঞ্চিত থাকে তাহলে সমাজের বাকি অংশ বদলাবে কিভাবে?

ইমাম ইবনুল কাইয়্যুম (রা.) অবশ্য নারীদেরকে `সমাজের অর্ধেক` বলতে নারাজ। তিনি বলেন, Women are one-half of the society which gives birth to the other half so it is as if they are the entire society. অর্থাৎ, নারীরা হলো সমাজের অর্ধেক। কিন্তু বাকি অর্ধেককেও তো নারীরা জন্ম দেয়। তারমানে নারীরাই যেন পুরো সমাজ।