প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

পূর্ব বাঙলার ভাষা

মঈনুল ইসলাম তুহিন

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৯, ২০১৯

এবাদুর রহমান সম্পাদিত `পূর্ব বাঙলার ভাষা` বইখানা প্রিন্ট করাইলাম সম্প্রতি। বইখানা মার্কেটে নাই; লতায়-পাতায় গাউছুল আজম মার্কেটের এক দোকানের পিসিতে বইয়ের যে কপি পাইলাম, তা আবার অসম্পূর্ণ। সেই অসম্পূর্ণ বই নিয়াই ফিরতে হইল, পরে সম্পূর্ণ কইরা দেওয়া হবে— এই আশ্বাসসহ।

বাস থিকা নামার পর সালাম চাচার দোকানে গেলাম। ইদানীং উনি দোকানে মিষ্টি রাখতে ধরছেন। একটা মিষ্টি হাতে তুইলা কামড় দিতে যাব, এইসময় খোঁচা খোঁচা দাড়িঅলা এক চাচা কইলেন, `বইটা দেখি?` আমি একটু ইতস্তত কইরা, দিলাম বইটা। মিষ্টি তাড়াতাড়ি খাব, না আস্তে আস্তে— ঠিক করতে পারলাম না। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভিতরেই উনি বইলা উঠলেন— `ভাষার বই, বাঙলা ভাষার বই। এই ভাষার জন্য রক্ত দিছে আলেমসমাজ, তাদের নাম কই? একজনেরও তো নাই।`

আশপাশের লোকজন চাচার বক্তব্যে মোটামুটি প্রভাবিত। তারা নিজ নিজ জায়গায় বইসা ও দাঁড়াইয়া থাইকাই, খালি চোখের কৌতূহলী চাউনি দিয়া আমারে আর চাচারে ঘিরা দাঁড়াইলেন। আমি প্রমাদ গুনলাম। কিন্তু চাচা থামে না। উনি আবার বলা শুরু করলেন, `এই যে এইখানে যারা আছে, নামগুলি পড়লাম আমি, সবগুলা চোর, বাটপার, রাজাকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় এগুলাই রাজাকার ছিল, বাটপার ছিল। আলেমসমাজ ব্রিটিশের সময় থিকাই আন্দোলন-যুদ্ধ করছে। কিন্তু তাদের ইতিহাস থিকা বাদ দিয়া দিছে এই চোররা।`

সংকলনের বেশিরভাগ লেখক আশি-নব্বইয়ের, অনেকে যুদ্ধের আগেই মারা গেছেন। কিন্তু এগুলা ওনারে বইলা লাভ হবে না বোধে, অফ গেলাম। কিন্তু উপস্থিত জনতার সজাগ সাইলেন্স— যার অর্থ হইল, `আপনে কিছু কইবেন, না হার মানছেন?`—টের পাইয়া, একটু প্রতিরোধের চেষ্টা করলাম। বললাম, `এইখানে তো আল মাহমুদের লেখা আছে, ফরহাদ মজহারের লেখা আছে। উনাদের তো আলেমসমাজ ভালো জানে।` ভাবলাম— এই ইয়র্কার মিস হইব না— ক্লিন বোল্ড। কিন্তু চাচা যে ভিভ রিচার্ডস, জানা ছিল না। উনি নগদে আমারে লেগের বাউন্ডারির ওইপাশে নিয়া ফালাইলেন— `আলেমরা পছন্দ করলেই উনারা ভালো লোক নাকি? এইগুলাও চোর, রাজাকার। আলেমরা যে যুদ্ধ করছে, ভাষা আন্দোলন করছে— এইখানে তারা কই?`

কঠিন বিপদ। ইয়র্কারে ছয় খাইয়া আমি আর বিশেষ ভরসা পাইতেছি না। গ্যালারিতে পিনড্রপ সাইলেন্স। চাচা কইলেন, `কিছু মনে কইরো না বাবা, তোমরা বইটই পড়ো, তাই বললাম আরকি।` বইলা, এক ধরনের উইনিং সেলিব্রেশনে চইলা যান যান অবস্থা। আমি পড়ছি চিপায়, চাচা বই দিতেছেন না, আমিও আসতে পারতেছি না; সমবেত জনতা পরের বলের আশায় তাকাইয়া আছে আমার দিকে, তারা চাইতেছে ম্যাচটা চলুক— বিরাট সংকট। এই মুহূর্তে, গ্যালারি থিকা আরেক চাচা,— বয়সে এনার কিছু বড়—, চায়ের কাপ থিকা মাথা তুইলা কইলেন, `আলেমরা তো একাত্তুরে রাজাকার ছিল। তুমি কী কও এগুলা?`

চাচা বইটা আমার হাতে দিয়া বক্তার দিকে তাকাইলেন। বুঝলাম, ঝড় আসন্ন। খেলা এইবার গ্যালারির দিকে গেছে, জান নিয়া মাঠ ছাড়া উচিত। ছাড়লাম।