প্রকাশকের কাজ আসলে কী

খন্দকার সোহেল

প্রকাশিত : মে ১৪, ২০২০

প্রকাশকের কাজ কী? এই প্রশ্নটি মাথায় নিয়ে ঘুরছি এক যুগ হয়ে গেল প্রায়! কিন্তু কূল-কিনারা মেলেনি অদ্যাবদি। বন্ধুরা যখন বলেছে বই ছাপার কথা, আমি বলেছি প্রকাশক বই ছাপেন না। প্রকাশক বই প্রকাশ করেন, বই নির্মাণ করেন। লেখককেও প্রকাশ করেন প্রকাশক। যখন একের পর এক বইমেলা আয়োজন করছি, বন্ধুরা বলেছে এইটা প্রকাশকের কাজ নহে! যখন ক্রিয়েটিভ রাইটিং ওয়ার্কশপ আয়োজন করেছি, বন্ধুরা বলেছে অযথা সময় আর অর্থ অপচয়ের ভূত মাথায় চেপেছে।

অন্য একটি দেশে নিজেদের লেখককে ব্র্যান্ডিং করতে যখন হল ভাড়া করে অনুষ্ঠান আয়োজন করলাম, বন্ধুরা বলল, মাথা গ্যাছে পুরাই! পৃথিবীর সবচাইতে বড়ো ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা দেখতে গেলাম। বন্ধুরা বলে মাস শেষ হলে এখনও যার ভাড়ার চিন্তা, তার এসব শোভা পায় না। ইস্তাম্বুল ফেলোশিপ প্রোগ্রামে অংশ নিলাম। বন্ধুরা বলে, ফলাফল শূন্য! ফেসবুক থেকে প্রতিদিন ভার্চুয়াল আড্ডা করলাম। বন্ধুরা বলল, আজাইরা থাকলে যা হয় আর কি! প্রকাশকের আর কাম নাই বুঝি?

অথচ আমি কিন্তু প্রকাশকের কাজটা খুঁজেই চলেছি। খুঁজতে খুঁজতে এই এত এত অকাজ করে চলেছি। কারণ প্রশ্নটার উত্তর যে মেলেনি এখনও। তাই প্রশ্ন মাথায় নিয়ে এখনও ঘুরেই চলেছি। আর এজন্যই হয়তো বন্ধুদের অপছন্দের কাজগুলো একটার পর একটা করেই যাচ্ছি। আমার আরও কিছু খুব কাছের বন্ধু আছে। তাদের কেউ কেউ বিনে পয়সায় আমার ব্র্যান্ডিং করেন। কেউ কেউ খন্দকার শব্দে অন্ধকার জুড়ে দেন আড্ডা-আলোচনায়। স্বপ্ন নিয়ে হাসি-তামাশা তাদের নিত্যকম্ম। আমি শুধু শুধূ স্বপ্ন দেখি, বেহুদা স্বপ্ন। যার কিছুই পূরণ হবার নয়, আর পূরণ করার যোগ্যও নই আমি।

আমি তাদের এই প্রচারণায় অনুপ্রাণিত হই। আশার আলো খুঁজে পাই। তাদের সমালোচনাগুলো আমার জন্য নয়া জ্বালানি হিসেবে নয়া টনিক হিসেবে কাজ করে। এই করোনাকাল অন্য অনেকের মতো আমাকেও নতুনভাবে অনেক কিছুই ভাবতে শিখিয়েছে। ২ এপ্রিল থেকে ভাষাচিত্র ফেসবুক পেজ থেকে লেখকদের নিয়ে ভার্চুয়াল আড্ডা শুরু করেছিলাম। মাসব্যাপী করেছি সেই আড্ডা। এরপর মন দিয়েছি ফেসবুক গ্রুপে। গ্রুপগুলোতে চোখ বুলাতে বুলাতে হঠাৎ মাথায় এলো, এই যে ফেসবুকের বইয়ের গ্রুপগুলোতে প্রতিদিন কতকত বুক রিভিউ পোস্ট হচ্ছে এগুলো আদতে কী কাজে আসছে আমাদের?

বুক রিভিউর ধরন ও ধারণা নিয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বললাম। কথা বললাম বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, লিটলম্যাগ এবং অনলাইনের সম্পাদকদের সঙ্গে। তাদের মুখ থেকেই শুনলাম বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশের সাহিত্য বা সাময়িকীগুলো যারা সম্পাদনা করেন তারা ভালো বুক রিভিউয়ার খুঁজে পান না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকে ইঙ্গিত করলে তারা যা জানায় তা হলো, ফেসবুকে বুক রিভিউ, পাঠক বা পাঠ প্রতিক্রিয়া এবং বইয়ের পরিচিতি সব একাকার হয়ে আছে বা যাচ্ছে। কোনটা বুক রিভিউ, কোনটা বইয়ের পরিচিতি আর কোনটা পাঠ প্রতিক্রিয়া তা বোঝার উপায় নেই।

এর মধ্যে অনেক লেখাই নাকি উদ্দেশ্যমূলক। সেটা কেমন? উত্তরে পেয়েছি, ফেসবুকে অনেক পেইড লেখা পোস্ট হয় বুক রিভিউর নামে। এগুলো প্রচারণামূলক পোস্ট। অনেক লেখক বা প্রকাশক নাকি এসব লেখার অন্তরালে কাজ করেন। কিছু আছে ফ্যান-ফলোয়ারদের ব্যাপার-সেপার। খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, কিছু মানুষ একই লেখকের বিভিন্ন বইয়ের আলোচনা-পরিচিতি পোস্ট করছেন বিভিন্ন গ্রুপে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে হয় এইসব পোস্ট। আবার কিছু মানুষ আছেন যারা অন্যকে দেখে বই নিয়ে পোস্ট দেন। এই পোস্টগুলোকে বলা যায়, আমি তো এমনি এমনি পোস্ট দিই ক্যাটাগরির।

সকলের আলোচনায় যেই ব্যাপারটি উঠে এসেছে তা হলো, যদি এইসব লেখাগুলো নার্সিং করা যায়, এইসব আগ্রহী রিভিউয়ারদের লেখাগুলোকে যদি ঠিকমতো গাইড দিয়ে তৈরি করানো যায় তাহলে একটি দেশে সমালোচনা সাহিত্য ব্যাপারটি হয়তো তৈরি হতে পারে। যা আমাদের দেশে এখন রীতিমতো জাদুঘরে খুঁজতে যাবার উপক্রম হয়েছে। লেখক স্তুতি, লেখার প্রশংসা, বইয়ের প্রচারণা বা বইয়ের বিজ্ঞাপন কিংবা লেখকের সমালোচনা এই হচ্ছে বর্তমানে বুক রিভিউর মোদ্দাকথা।

বিভিন্ন মাধ্যমের সম্পাদকদের পরামর্শক্রমেই এই কঠিন একটি কাজে হাত দেয়া। বুক রিভিউ নিয়ে ধারাবাহিক কিছু কাজ করার ইচ্ছেটা তৈরি হওয়া। উদ্দেশ্য কী? যদি দেশে সত্যিকার কিছু সাহিত্য সমালোচক তৈরি হয়। যদি দেশের সমালোচনা সাহিত্যের শাখাটিতে কিছু মেধাবী লেখক যুক্ত হয়! এই যদি-কিন্তু মাথায় রেখেই আমাদের নতুন এই যাত্রা। এই যাত্রাপথটি হবে দীর্ঘতর। উদ্যোগ-আয়োজন হবে আরও। হয়তো সেটা করোনাকাল শেষে। কিন্তু একটা কিছু শুরু করাটা প্রয়োজন। এই শুরুটাই হচ্ছে ১৫ মে ২০২০। সঙ্গে সারথি হয়ে আছেন তিনজন অভিজ্ঞ অগ্রজ।

কবি, সাংবাদিক ও লেখক এবং বর্তমানে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর। প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ও সম্পাদক আহমাদ মাযহার এবং প্রাবন্ধিক, লেখক, গবেষক ও শিক্ষক হামীম কামরুল হক। বুক রিভিউ নিয়ে আশা করি তিনজনের কাছ থেকেই আমরা একটি প্রাথমিক এবং স্বাপ্নিক পথচলার ধারণা পাবে। আশা করি আমাদের নতুন এই স্বপ্নযাত্রায় সহযাত্রীদের পরামর্শ ও সহযোগিতা পাবে। পরামর্শ চাই। এবং শেষকথা হলো, এই কাজটি কি প্রকাশকের? এই বিষয়েও বন্ধুদের পরামর্শ প্রত্যাশা করি।