ফেসবুকীয় হালখাতা

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৭, ২০১৯

লুতুপুতু ফেসবুকার: এরা শুধু সরি ভাবি, সরি ভাই, আই ফিল সরি ফর ইউ টাইপের ফেসবুকার। এদের ভালোত্ব গড়ায় গড়ায় পড়তে থাকে পোস্টিং আর কমেন্ট দিয়ে। ফেসবুকে অন্যের প্রতি এদের প্রচুর ভার্চুয়াল মায়া থাকে। এদের পোস্টিং পড়লে মনে হয় ওদের থাকার কথা স্বর্গে কিন্তু ভুল বাসে চড়ে ওরা মর্ত্যে এসে উপস্থিত হয়েছে।

সাইলেন্ট ফেসবুকার: এরা খুব লাজুক। চুপচাপ বসে সবার পোস্টিং দেখে, যাদের পোস্টিং ভালো লাগে তাদেরটা বেশি করে দেখে কিন্তু কোনো লাইক বা কমেন্ট করে না এবং বুঝতেই দেয় না যে, এরা সবকিছু দেখছে। এরা কিছুটা ফেরেসতাদের মতো অর্থাৎ সাথে থাকলেও বোঝা যায় না।

সমাজ পাল্টে দেয়া ফেসবুকার: এরা আজব এক ধরন, এরা সাধারণত অন্যের প্যান্ট খোলার বিষয়টা ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিতে ভালোবাসে এবং প্যান্ট কিভাবে বন্ধ রাখতে হয়, সে ব্যাপারে অযাচিত ভাবে প্রেসক্রিপশন দেয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এদের নিজেদের প্যান্টই আজীবন অর্ধেকের বেশি খোলা থাকে সার্বক্ষণিক ভাবে।

আদর্শ ফেসবুকার: এদের ধারণা, ফেসবুকে বসার আগে ওজু করে আসতে হয়। ফেসবুকে শুধুমাত্র আদর্শের কথা বলতে হয়, ফেসবুকে ও সোশ্যাল মিডিয়াতে লেখার জন্য নেটিকেটের উপর পিএইচডি থাকা প্রয়োজন। যদিও নিজেরদের পেটিকোটের ফিতার ঠিক থাকে না। এরা ভাবে, ফেসবুক হলো বাংলাদেশ টেলিভিশনের আলোচনা অনুষ্ঠান। তাই এখানে প্যান্ট সার্ট পরে বসে ভদ্র ভাষায় টাইমলাইনে লিখে একজন গেজেটেড অফিসারের সাইন নিয়ে পোস্ট করা খুব জরুরি। টাইমলাইনে কোনো বাজে কথা লেখা যাবে না, শুধু লুতপুতু করতে হবে যাতে করে মানুষ ভাবে যে, ওর মতো ভালো ছেলে বা মেয়ে এই সৌরজগতে একটাও নাই।

পাগলের সুখ মনে মনে ফেসবুকার: এরা নিজেরা নিজেরা ভাবে যে, আমি হিরো হইয়া গেছি। সবাই আমাকে দেখছে, সবাই আমাকে নিয়ে ভাবছে, আমি সবাইকে পথ দেখাবো, আমি ছাড়া এদেরকে রক্ষা করার আর কেউ নাই, আমি মরে গেলে এদের কি হবে! বাস্তবে এরা সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারে এন্ড ভার্চুয়াল হ্যালুসিনেশনে ভোগে। কিন্তু কেউ এদের সেটা ধরিয়ে দেয় না বলে রোগ আরও বাড়তে থাকে দিনে দিনে।

অভিমানী ফেসবুকার: এরা মাঝে মাঝেই ফেসবুক ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয় দেখায় ফ্রেন্ডদের এবং চলেও যায় অনেকে ১৫ দিনের জন্য, তারপর আবার যথারীতি ফিরে আসে কানতে কানতে এবং এসে বলে, দর্শকদের বিশেষ অনুরোধে আরেকটি গান গেয়ে শোনাচ্ছি।

নেগেটিভ ফেসবুকার: এরা মজার বা নর্মাল বিষয় নিয়ে কোনো পোস্ট দেয় না বা অন্য কেউ দিলে পোস্টে লাইক দেয় না বা কমেন্টও করে না। এদের ধারণা, ওরা ছাড়া সবাই খুবই সাধারণ খেটে খাওয়া খোকন। কিন্তু যেই মুহূর্তে নেগেটিভ কোনো পোস্টিং দেখে এরা ঝাপিয়ে পড়ে এবং সম্পূর্ণ নিজের মনগড়া গুরুত্বপূর্ণ আত্মদর্শন তুলে ধরে জনগণের সামনে। এদের সবকিছুর ব্যাপারে মহা বিরক্তি। এদের ইচ্ছা করে সবাইকে খুব থাবড়াইতে।

পজিটিভ ফেসবুকার: সবকিছুকে সহজ ভাবে নেয় অর্থাৎ কোনো কিছুইকেই বেশি ভিতরে নেয় না। এরা খুবই কম সময় দেয় ফেসবুকে। খুব একটা পোস্টও এরা দেয় না, মাঝে মাঝে দেয় আবার হারিয়ে যায়। এদের মনের ভিতরটা সব ব্যাপারেই পজিটিভ।

ফাজিল ফেসবুকার: সারাদিন যতরকম ফাইজলামি করা যায় ফেসবুকে, এরা করতে থাকে। মাঝে মাঝে মানুষের বিরক্তির কারণও হয়। এরা একটু বেহায়া হওয়ায় এদের লাজসরম বলে কিছু থাকেনা, খুব বাজে কথাও ফেসবুকে বলতে লজ্জা পায় না।

প্রেমিক ফেসবুকার: এদের প্রতিটা পোস্ট, ছবি, কমেন্টে প্রেম গড়ায় গড়ায় পড়তে থাকে। এদের ছবিতে ব্যাপক ফিল্টার ইউজ করা হয়ে থাকে। ফেসবুক বা ফোটোশপ যদি ফিল্টার না তৈরি করতো, এদের বেশির ভাগ ছবি ফ্লপ সিনেমার মতো ফ্লপ করতো।

দুখি ফেসবুকার: জীবন খুবই দুঃখের, এ জীবন আর রেখে কোনো লাভ নাই, সারাটাজীবন শুধুই কষ্ট আর কষ্ট– এই ধরনের পোস্টিঙে ভরপুর এদের টাইমলাইন। এদের জীবনে কষ্ট ছাড়া কিছুই নাই তাই পোস্ট করা ছবিগুলি শুধু কষ্টের ছবি। এদের একটাই গান, দুঃখ আমার বাসর রাতের পালঙ্ক।

টিপটপ ফেসবুকার: এদের পোস্টিং দেখলে মনে হয়, টিভিতে অ্যাড দেখছি। ভীষণ টিপটপ, গোছানো, সাজানো ঘরবাড়ি, দামি জামা কাপড়, ব্র্যান্ডেড সবকিছু। কিছুটা জিটিভি টাইপ। এদের টাইমলাইনে একটাও সাধারণ ছবি পাওয়া যায় না। সুন্দর করে বাসা গুছিয়ে রাখার মতো এরা টাইমলাইন খুব সন্দর করে গুছিয়ে রাখে।

আতেল ফেসবুকার: এদের টাইমলাইন এমন ভাবেই এরা সাজায় যে দেখলে মনে হয় “সেরাম ছেলে, জ্ঞ্যানে জ্ঞ্যানে জর্জরিত, অসম্ভব ট্যালেন্ট, প্রচুর চেগুইভেরা ঘ্যাসা কথাবার্তা, অন্য লেভেলের জ্ঞ্যানে ভরা চিন্তা চেতনা, দেশের কবি সাহিত্যিকরা এদের কাছে ছেলে মানুষ, হুমায়ূন আহমেদ কোন লেখক বা সাহিত্যিকই না এদের কাছে। এদের টাইমলাইন স্ক্রল করলে মনে হয় ভুল বাসে উঠে পড়েছি, যাবো যশোর কিন্তু উঠেছি ছাগলনাইয়ার বাসে।

ফেইক ফেসবুকার: এরা অন্যনামে ফেসবুক করে কয়েকটা কারণে, কেউ মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য, কেউ অন্যের টাইমলাইনে গিয়ে কাউকে অপমান করার জন্য, কেউ নিজের পরিচিত কাউকে ফলো করার জন্য, ইত্যাদি। এদের ব্যাপারে একটাই কথা, কুকুর হইতে সাবধান।

ছবিবিহীন ফেসবুকার: এদের অ্যাকাউন্টের কোথাও এদের নিজের একটাও ছবি থাকে না। আমার মতে, এরা ডেঞ্জারাস। অর্থাৎ এদের নিয়ত প্রথম থেকেই ভালো থাকে না। কোনো একটা বিশেষ কারণে, যেটা শুধু সে নিজে জানে, এরা নিজেদের ছবি ব্যবহার করে না। এদের ব্যাপারে একটাই কথা, সাবধান। যখনি দেখবেন কোথাও কোনো ছবি নাই অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের, তাকে বন্ধু না করাই শ্রেয়।

কন্টেন্টচোর ফেসবুকার: এদের কাজই হলো চুপচাপ থাকা এবং ভালো মাল, তা সেটা গান হোক, কবিতা হোক, গল্প হোক, চোষা দেয়া এবং মালটাকে একটু এদিক সেদিক কইরা সংগৃহীত কইয়া মার্কেটে চালাইয়া দেয়া।

রাজনীতিবিদ ফেসবুকার: এরা ফেসবুকেই দেশের উন্নতি সাধন করে থাকে এবং পৃথিবী নাড়িয়ে দেয় টাইমলাইনে। দেশ চালানোর ব্যাপারে টাইমলাইনে এদের নিজেদের উদ্ভাবিত যে ইন্সট্রাকশন থাকে, সেগুলি ফলো করলে অ্যামেরিকার মতো দেশও আরও উন্নত হয়ে যাওয়ার ১১০% সম্ভবনা থাকে। এরাই আসল ভার্চুয়াল দেশপ্রেমিক।

ট্রান্সজেন্ডার ফেসবুকার: এদের প্রোফাইল পিকচারে খুবই সুন্দরী অথবা যৌবনবতী মেয়ের ছবি থাকলেও এরা আসলে পুরুষ। ঐ ছবি দেখে সরল, মাজুল ও কামুক কিছু লোক এদের রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে এবং মনে করে, পাইয়া গেসি সুপার মাল। এই মহিলারূপি নালায়েকগুলি আসলে একেবারেই পারভারটেড, পুরুষদের যৌবনজ্বালা সংক্রান্ত ইনবক্স পড়ে মজা নেয়।

বন্ধু সংখ্যাভিত্তিক ফেসবুকার: এদের ফেসবুকের অবস্থা টইটুম্বুর ভরা যৌবনের মতো অর্থাৎ ৫০০০ হাজার বন্ধু অনেক আগেই পূর্ণ হয়ে গিয়েছে এবং এই বন্ধুদের কেউ কাউকে চিনে না, অ্যাকাউন্টের মালিক নিজেও কাউকে চিনে না এবং চেনার দরকারও নাই। এদের বন্ধু হলে নিজেকে মনে হবে গুলিস্থান হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি এবং হাজার হাজার লোক হেঁটে যাচ্ছে কাউকেই চিনি না। এদের অ্যাকাউন্টকে কেয়ামতের ময়দান অথবা কমিউনিস্ট পার্টির অফিস বলা যেতে পারে। কারণ এখানে বাদাম বিক্রেতা থেকে শুরু করে জুকারবার্গ, মায়া হাজারিকা, মাহফুজুর রহমান, রোজিনা, মাইকেল জ্যাক্সন, উত্তর পাড়ার মফিজ শেখ, ছলনাময়ী ও ললনাময়ি নায়িকা অ্যাঞ্জেল বকুল বেগম, ভুরুঙ্গামারি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইসলামিয়াত স্যার, পাশের বাসার ডেস্পারেড হাউজওয়াইফ পুস্পরানী, দক্ষিন পাড়ার রোক্সানা, সবাই থাকে। এদের রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করার একদিনের মধ্যে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টে ভরে যাবে আপনার আকাউন্ট এবং উপরের লিস্ট থেকে (বাদাম বিক্রেতা.........রোক্সানা) সবাই রিকোয়েস্ট পাঠাবে। বন্ধু ভিত্তিক ফেসবুকারদের এটা একটা বিশেষ গর্বের বিষয় যে, ওনার বন্ধুর সংখ্যা ৫০০০ এবং আরও ২০০০০ লাইন ধরে ফলোয়ার হয়ে আছে।

প্রোফাইল লক ফেসবুকার: মাজুল ফেসবুকার। এরা ম্যাক্সিমাম গাঁয়ের বধু কিংবা রাখাল ছেলের দল। অনেক সময় বাদাম বিক্রি করা ফেরিওয়ালাও পাওয়া যেতে পারে এই প্রজাতিতে। এরা হলো সুন্নি অর্থাৎ শুইনা মুসলমান। তার মানে এরা শুইনা প্রোফাইল লক কইরা দিসে কিছু না বুইঝা। এরা শুধু লক করতে শিখসে, খুলতে শিখে নাই বইলা আর খুলতে পারে না। হাজার মানুষের গালি খাওয়ার পরও লক আর খোলা হয়না যেহেতু জানে না ক্যামনে খুলে।

মিউজিসিয়ান ফেসবুকার: এদের নামের আগে ইন্সট্রুমেন্টের নাম থাকে, যেমন গিটার বাবুল, কিবোর্ড মফিজ, সিংগার নরেন কিংবা কম্পোজার ব্যোমকেশ। টাইমলাইনে তাবত খ্যাপের ছবি এবং বেশির ভাগ প্রোগামেই জিন্সের প্যান্টের সাথে লাল সার্ট পরা।

আব্বা স্থানীয় ফেসবুকার: এরা সাধারণত ষাটোর্ধ্ব ফেসবুকার এবং ফেসবুক চালানোর পূর্বদক্ষতা নাই বলে মাঝে মাঝেই খাদে ফেলে দেয় ফেসবুককে নিয়ে। এরা পুত্র স্থানীয় ছেলে বা মেয়েদেরকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে কোন একটা বিশেষ পোস্টিঙে কমেন্টের মাধ্যমে কিছু ফেসবুক বন্ধুদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মাঝখানে ঢুকে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে বসে, যেমন ‘তোমার বাবা কেমন আছেন, ওনার বাতের ব্যথাটা এখন কেমন?’