বই খেকো

নাঈমুল হাসান

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৩, ২০২০

অসংখ্য বই জমে গেছে। পড়ার সুযোগ করে উঠতে পাড়ছি না। বইয়ের দোকানের সামনে গেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ি বই কিনতে। পুরনো বইগুলোই শেষ করতে পারি না। তবুও নতুন বইয়ের নেশায় পেয়ে বসে আমাকে। বই দেখলেই যেন কিনতে হয় আমার!

 

বইয়ের প্রতি এমন ঝোঁক কখন থেকে শুরু হলো ঠিক বলতে পারব না। হয়তো ছোট থেকেই। বই দেখলেই গিলতে ইচ্ছে করে। ভালো হোক কিংবা মন্দ, বই হলেই হলো। প্রথম যে বইটি পড়ে আমি আনন্দ পেয়েছিলাম, বইকে মজার ভাবতে শুরু করেছিলাম, সেই বিখ্যাত বইটি পড়েছিলাম সিলেটে, আমার ফুফুর বাড়িতে।

 

আমার ফুফাতো বোন, সম্ভবত তখন তিনি ক্লাস নাইনে পড়ে। আমি তখন দশ কি এগারো বছরের কিশোর। আপু আমার হাতে তুলে দিলেন ইউনিসেফ এর সহায়তায় প্রকাশিত কিশোর গোছের একটা সাহিত্যের বই। বইটিতে রঙিন ছবি দিয়ে গল্পটা বলা। গল্পের প্লটের সাথে বইয়ের ছবিগুলোর হুবুহু মিল পাচ্ছিলাম বলেই হয়তো ততটা আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম বইটা। হয়তো ওটাই ছিল আমার প্রথম বই, যেটা আমি আনন্দ নিয়ে পড়ে শেষ করেছিলাম। এখন প্রতিটা বই-ই অানন্দ নিয়ে শেষ করি, তবে ওই বইটা পড়ার অানন্দ এখনো স্পর্শ করতে পারেনি বর্তমানের বইগুলো।

 

আমাদের সময়কার ছেলেমেয়েদের গল্প পড়ার অভ্যস্ততা তৈরি করে `তিন গোয়েন্দা` সিরিজ বইগুলো। আমি কেন যেন সেই সিরিজে বইগুলোর বাইরের কেউ ছিলাম। অন্তত একটা তিন গোয়েন্দা সিরিজও পড়া হয়নি আমার। বড়ই আফসোসের ব্যাপার! আমার বাসায় বেশ কিছু ধর্মীয় গোছের বই ছিল, আমি পাঠক হয়ে ওঠলাম সেগুলোর। মাসলা-মাসায়েল হলো আমার পড়া প্রথম সাহিত্যগুলোর মধ্য অন্যতম।

 

এরপর শুরু হয় অনুবাদ সাহিত্য পড়া। ভিনদেশি লেখকদের সুন্দর সেই কথাগুলো সুনিপুণ বাংলায় মেলে ধরতেন বাংলা সাহিত্যর পরিশ্রমী কিছু সাহিত্যিকেরা। পরিশ্রমী বলছি এই জন্য যে, একটা সময় লেখকরা মৌলিক লেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। গবেষণাধর্মী লেখা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কলাম, ঐতিহাসিক, সামাজিক ইত্যাদি। শিশুদের জন্য লেখকেরা ভিনদেশি সাহিত্য অনুবাদ করবার তাগিদে আলাদা সময় বের করছেন, ভিনদেশি রূপকথা, উপকথা শিশুদের জানাচ্ছেন। এটা বড় মহৎ কাজ। শিশু সাহিত্য সবাইকে দিয়ে হয় না, তাই যারা মূলধারার সাহিত্যের পাশাপাশি শিশু সাহিত্য নিয়ে কাজ করেন, তারা অবশ্যই আমার দৃষ্টিতে পরিশ্রমী সাহিত্যিক।

 

এরপর শুরু হয় নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বই পড়া। যারা বলেন, ওনার বইয়ে কিছু নাই, সব আউল-ফাউল জিনিস। তাদের জানা উচিত, যাদের বই পড়ে আপনারা বলছেন, অসাধারণ লেখনি, দুর্দান্ত মনোভাব এবং তুলনা করছেন হুমায়ূন আহমেদের সাথে। ওনাদের ওসব সাহিত্যের কিছুই বুঝতেন না, যদি না হুমায়ূন সাহিত্য না পড়তেন। এক্ষেত্রে চলিত বাংলা ভাষার প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরীর একটি বিখ্যাত উক্তি প্রণিধানযোগ্য, "সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানুষের মনকে আনন্দ দেয়া।"

 

হুমায়ূন আহমেদ সেই কাজটিই করেছেন। হাতের পাঁচটি আঙুল যেমন সমান নয়, তেমনি সাহিত্য প্রকাশের ভাবনা গুলোও সব সাহিত্যিকের সমান নয়। সব সাহিত্যিকই যদি জ্ঞান দেবে, আলোকিত করবে, তাহলে আনন্দ দেবে কে? কে তুলে ধরবে একান্নবর্তী পরিবারের দুঃখগাঁথা গুলো, কে তুলে আনবে বাকের ভাইয়ের মতো মস্তানের মধ্যে ভালো মানুষি মানুষগুলোর চরিত্র? কে এনে হিমু আর রূপাকে দাঁড় করাবে মুখোমুখি, কে রহস্যভেদ করতে বেরিয়ে আসবে মিসির অলি হয়ে কিংবা নিষ্কলুষ, নিরহঙ্কার শুভ্রকে কে বন্দি করবে বইয়ের মলাটে?

 

‘জোছনা ও জননীর গল্প` পড়েছেন? `বাদশা নামদার`, `মাতাল হাওয়া`, `মধ্যাহ্ন` `মিসির আলি সমগ্র` কিংবা আমাদের পাগলা `হিমু`? পড়েছেন কি? না পড়ে থাকলে প্লিজ পড়ুন। তারপর বিচার করুন লেখককে।

 

রবীন্দ্র-নজরুল তো সকলেরই বিশেষ প্রিয়। আমারো ব্যতয় নেই। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের প্রেমে পড়েছিলাম উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময়। হৈমন্তীকে যে কতবার স্বপ্নে দেখেছিলাম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক রবীন্দ্রনাথ শত যুবকের মনে হৈমন্তিক প্রেম উথলে দিয়েছিল। 

 

আরেক যাদুকরী লেখকের সাথে আমার পরিচয় হয় তখনই। নাম জহির রায়হান। কী অসাধারণ লেখনি তাঁর! "তপুর সাথে আবার দেখা হবে ভুলেও ভাবিনি আমরা--" লাইনগুলো মনে পড়ে কারো? `একুশের গল্প` দিয়েই তাঁর সাহিত্যে আমার আত্মপ্রকাশ হয়। ওনার সাহিত্য পড়তে গিয়েই জানতে পারলাম অন্য আরেক চমৎকৃত তথ্য। জহির রায়হান বাংলা চলচ্চিত্রের এখনো পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক। `জীবন থেকে নেয়া` চলচ্চিত্রটি দেখেছেন নিশ্চয়? এটি ১০ এপ্রিল ১৯৭০ এ মুক্তি পায়। ঐ চলচ্চিত্রে তিনি `আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি` গানটি চিত্রিত করেন।

 

সম্প্রতি তিনজন লেখক আমাকে বেশি টানে। বনফুল তথা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, হুমায়ূন আজাদ, শাহাদুজ্জামান। তাদের বই বেশি বেশি পড়া হচ্ছে আজকাল। আজকাল পড়া হচ্ছে মানে সুযোগ হলে ওনাদের বই পড়ি, কিন্তু সুযোগ হয় না। বড্ড ব্যস্ত আমরা। অথচ মানবকুলের প্রতি মহান স্রষ্টার প্রথম আদেশ ছিল, "পড় তোমার প্রভুর নামে। যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।" হেরা গুহায় জিবরাঈল (অা:) এই শাশ্বতী বাণীই নিয়ে এসেছিল আমাদের উপর।