বঙ্গবন্ধু ও মাওলানা তর্কবাগীশ

বঙ্গবন্ধু ও মাওলানা তর্কবাগীশ

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল মাওলানা তর্কবাগীশ হবেন

সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ

প্রকাশিত : আগস্ট ২০, ২০১৯

দুজন মাওলানা আমাদের জাতি গঠনের ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছেন। বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এই দুজনই আবার বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু। একজন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অন্যজন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ।

মাওলানা তর্কবাগীশ ছিলেন আজীবন সংগ্রামী মানুষ। তর্কবাগীশ একাধারে জাতীয় নেতা, স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তসিঁড়ি সলঙ্গা বিদ্রোহের মহানায়ক, ঋণসালিশী বোর্ড প্রবতর্নের পথিকৃৎ, বর্গা আন্দোলনের অবিসংবাদিত কাণ্ডারি, মহান ভাষা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের বীরযোদ্ধা, দেশ ও জাতির প্রয়োজনে অকুতোভয় যোদ্ধা এবং আজীবন গণমানুষের নেতা।

তিনিই প্রথম পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাংলায় বক্তৃতা করেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে প্রকাশ্য প্রতিবাদকারী। তিনি ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা। তেজস্বী ছিল তার ভাষণ। যে ভাষণের সীমাহীন ভক্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু তরুণ বয়েসে স্বপ্ন দেখতেন, তিনি একদিন তর্কবাগীশের মতো বক্তৃতার মন্ত্রে বাঙালি জাতির সুপ্তি ভাঙবেন।

১৯৫৬-২৯৬৭ সাল পর্যন্ত একটানা দশ বছর মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কাবগীশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখন যুগ্ম সম্পাদক, পরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তর্কবাগীশের সাথে। শেখ মুজিবুর রহমানের মানস গঠনে তর্কবাগীশের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। তার রাজনৈতিক দর্শন, বক্তৃতার স্টাইল, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম— সবই ছিল তর্কবাগীশের প্রভাবে আচ্ছন্ন।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বড় একটা অংশ কেটেছে এই মাওলানার সান্নিধ্যে। তিনি তর্কবাগীশের ছায়াসঙ্গি হয়ে থেকেছেন সেই সময়টায়, ইতিহাস এটাই প্রমাণ করে। তিনি মাওলানাকে কাছে থেকে দেখেছিলেন। আর মাওলানা প্রিয় সহকর্মী, য় শিষ্যকে কাছে থেকে গড়েছিলেন। দুজনের জীবনের নানান স্মৃতিকথা কিংবদন্তির মতো ছড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে ইতিহাসের পরতে পরতে।

এমনি একটি স্মৃতিকথা তুলে ধরা হলো— ‘বঙ্গবন্ধু আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। উনি আমাকে আগে থেকেই চেনেন। আমাদের দিনাজপুরের বাসায় দেখা হয়েছে। মাওলানা তর্কবাগীশ আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। নাম বল্লাম। আব্বা আমাকে বললেন, উনি তোমার মাওলানা তর্কবাগীশ চাচা।’ এরপর সেই ৩৬ মাইলের বর্ণনা দেন মুজতবা আহমেদ মুরশেদ, ‘ঠাকুরগাঁ থেকে ৩৬ মাইল পথভেঙে গাড়ি ছুটছে। বঙ্গবন্ধু গুনগুন করেরবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর ভাঁজছেন। মাইল কয়েক পরপরই জনতার ঢেউ। বঙ্গবন্ধুকে ভাষণ দিতেই হবে। গাড়ি থামছে এবং বঙ্গবন্ধু সাদা হ্যান্ড মাইক হাতে মিনিট তিন চারেক করে ভাষণ দিচ্ছেন। আবার ছুট।’

‘চলন্ত গাড়িতে বঙ্গবন্ধু, আব্বা, মাওলানা তর্কবাগীশ মাঝে মাঝেই নির্বাচন বিষয়ে কিছু কিছু কথা বিনিময় করছেন। এমন সময় হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে মাওলানা তর্কবাগীশ আমাকে প্রশ্ন করলেন, বড় হয়ে কি হতে চাও? এক মুহূর্তে আমার হয়ে বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন, ও তর্কবাগীশ হবে।’ আমি বাদে উনারা একসাথে হোহো করে দিলখোলা হাসি হেসে নিলেন। তর্কবাগীশ বললেন, মুজিব তুমি সবাইকে তর্কবাগীশ বানিয়ে দিবে নাকি। আব্বাকে বললেন, সে নিজেও তর্কবাগীশ হতে চায়। মওলানা তর্কবাগীশ বঙ্গবন্ধুর টোকাটুকু উপভোগ করেছেন।’ ‘বিস্ময়কর হলো, পরবর্তী সময়ে আমি জাতীয় পর্যায়ে বিতার্কিক হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক সংঘের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। উনারা কেউ নেই আজ। আমার বুকের ভেতর আছে কেবল প্রতিধ্বনি।’ (বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ৩৬ মাইল, মুজতবা আহমেদ মুরশেদ/১৫ আগস্ট ২০১৫/চ্যনেল আই)

মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশেরর নাতি সৈয়দ হাদী তর্কবাগীশ একুশের সংকলনে ‘অগ্নিগর্ভে একুশ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন প্রথম তর্কবাগীশের সাথে দেখা হয় সেদিন বলেছিলেন, নেতা আমি আপনার মতো বক্তা হতে চাই। হ্যাঁ, একদিন তিনি এমন এক বক্তৃতা দিলেন, তর্কাবগীশের বক্তৃতা হার মানালো। তিনি বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হলেন। তার সেই বক্তৃতা তাকে তর্কবাগীশ হবার স্বপ্ন কেবল নয় তার চেয়ে অনেক উঁচুতে পৌঁছে দিয়েছিল। ৭ মার্চের বক্তৃতায় তিনি গুরুর মতো এক কিংবদন্তির ভাষণে উদ্বেলিত করলেন পুরো জাতিকে। সেই ৭ মার্চের অমর ভাষণ পৃথিবীর সেরা বক্তৃতার একটা। এটি শুধু কোনো বক্তৃতা নয়, এক অমর কবিতা। এক অমর ইতিহাস।’