বাংলা সমাজে সংস্কৃতির কারখানা নাই

মৃদুল মাহবুব

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৫, ২০১৯

সংস্কৃতি ব্যাপারটার মধ্যেই আনন্দ আছে। তবে সব সংস্কৃতির আনন্দ প্রকাশের ধরন এক না। এটাই স্বাভাবিক। তবে সংস্কৃতি তৈরি হয়, করা হয়। রবীন্দ্রাথতো ইউরোপফেরতা। যে বয়সে মানুষের চারপাশ সম্বন্ধে ধারণা তৈরি হয়, যেসকল ধারণা সারা জীবন শাসন করে সেই তারুণ্যের মুগ্ধতা নিয়েই তিনি ইউরোপ গিয়েছিলেন। আমি ধরেই নিয়েছি জমিদার পুত্র হিসাবে, ঠাকুর পরিবারের লোক হওয়ার কারণে গায়ের রং তার ইউরোপ সংস্কৃতি বোঝার জন্য কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় নাই।

রবীন্দ্রনাথ তার জীবনচর্চার অনেক জায়গায়ই ফুল-টাইম ইউরোপিয়ান, অন্যান্য ইন বিটউন কালো আদমিদের মতো অ্যামেচার বা পার্ট-টাইম তিনি মোটেও ছিলেন না। সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি কারখানায় ইউরোপের কলকব্জা থাকার কথা ছিল। সেই কারখানার অ্যাকাউন্টিং, ফাইন্যান্স পদ্ধতি, ম্যানেজমেন্ট সবখানে পশ্চিমাকরণ থাকার কথা। মানে নিউ ইয়ারের মতো একটা ধুম ধারাক্কা, মার-মার কাটকাট, জীবন বাজি রাখা নাইট লাইভ নিউ ইয়ারের পরিবর্তে নিবেদন মূলক, বন্দনা মূলক দিবসময় বাংলা নববর্ষ রবীন্দ্র সংস্কৃতির উৎপাদ।

সঙ্গীত হলো সংস্কৃতি সবচেয়ে শক্তিশালী বাহন। জনসংস্কৃতি সঙ্গীত বাহিত। এই বিষয়টা প্রথমত রবীন্দ্রনাথ, তারপর আমাদের রকার-রা বুঝছিল। ফলে পরবর্তীতে রকার-রা ‘মেলায় যাই রে’ টাইপ গানটান গাইলো অনেক, নিবেদনের পরিবর্তে ঝাকা-নাকা-ঝাকা-নাকা টাইপ নিয়া চেষ্টা চরিত্র করল। সেই চেষ্টার ফলে বাংলা নববর্ষে আনন্দ আনন্দ একটা ভাব এলো বটে। এর আগে নববর্ষ একটা ধর্মীয় ও খুচরা ব্যবসার ব্যাপর ছিলে। নববর্ষ এখন ব্যাপক উৎসব কর্মকাণ্ড। সংস্কৃতির এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে না পারার কারণে আপনি এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। বাংলাভাষীদের নববর্ষে যা কিছু আনন্দ জাগানিয়া তা এই রকারদের সৃষ্ট। রবীন্দ্রনাথের পর জনসংস্কৃতির নতুনত্বের কারিগর রকাররা, কবি, সাহিত্যিকরা না। নতুন জনসংস্কৃতি তৈরিতে তাদের ভূমিকা মনে রাখা দরকার আছে। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা নাই।

বাংলাভাষী গান লিখিয়ে আর গাইয়েদের দৈন্যতার কারণে রকার-দের নিউ-বাংলা নববর্ষ আর আগাইলো না। মানে, নববর্ষ নিয়ে আর ভালো গান লেখা হয় না বা আমার কান নাই, আমি শুনি না। কবিতার কথা বাদ দিলাম। মানে নববর্ষ সংস্কৃতির যে যাত্রা দাড়িওয়ালা ঠাকুরের হাত ধরে, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কেউ নাই বাংলা সমাজে। এইখানে সংস্কৃতির কারখানা নাই। সংস্কৃতি উৎপাদন ও রিনিয়ালের কারখানা না থাকার দরুণ আপনি নানা দল মতের মধ্যে হানাহানি দেখবেন। শক্তিশালী কালচারের ফ্যাক্টরি সকল মতকে একই জিনিস পালনে বাধ্য করে।

আমাদের কালচারে মেশিনের জোর কম। ফলে ইলিশ খাবেন, কী খাবেন না, পালন করলে ধর্ম থাকে কী থাকে না, নানা প্রশ্ন দেখা দিবে। কালচারের শক্ত উৎপাদন না থাকাই এই সমস্তের কারণ। যারা যার তরিকার নানা রকম কালচারাল প্রোডাকশন থাকলে মারমার কাটকাট অবস্থান সমাজে কমতো। ফলে, যে সংস্কৃতির রি-নিউয়্যাল নাই তা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে অপ্রয়োজনীয় আরোপন ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। তখন সংস্কৃতিরে আপনার মনে হবে কর্পোরেটের পুঁজি। আপনি সংযোগ অনুভব করবেন না। কেননা সেই যাপনটাই যতন নাই, তখন এটারে ভিনদেশীও মনে হতে পারে। আর সংস্কৃতির ব্যবসা নিয়া কর্রোরেটরে দুশে লাভ নাই, সোনা। এটাই তার চরিত্র। বাঘের কাছে আপনি মানবিবতা আশা করে জঙ্গলে বসে থাকুন। মাড রাইস আর হিলসা ফিসেজ ফ্রাই নিয়াই আমাদের বুদ্ধিতারকাদের চকচকে বাণী, গালি, পরামর্শ, মন্ত্র এইগুলা দেখে বোঝার উপায় নাই রি-নিউয়্যাল একটা দরকারই দরকার।

নতুন দম ফাটানো আনন্দের গান গাওয়া হোক বন্ধুরা। জীবনে আনন্দ চাই, গৃহকোনে নিবেদনের আনন্দ চাই। প্রতি-তাত্ত্বিকতার চেয়ে রমনার রবীন্দ্র আর পানতা ব্যবসা বরং ভালো।

লেখক: কবি