ব্যাঙের বিয়ে: মেঘ দে পানি দে ছায়া দে
আশরাফ রোকনপ্রকাশিত : এপ্রিল ১১, ২০২০
চৈত্র যাই যাই করছে, কাঠফাটা রোদ্দুরের দেখা নেই; এখন আর আগের মতো গরম পড়ে না! পড়লে এমন চৈত মাইস্যা রাতেও কাঁথাকম্বল টানতে হতো না! প্রকৃতি যেমন বদলেছে বদলে গেছে, মানুষের সনাতন জীবনধারাও! এখন আর আগের মতো গরমও পড়ে না, কৃষকেরাও বোধ করি তাই আগের মতো বৃষ্টির জন্যে আকাশের দিকে চেয়েও থাকে না।
এছাড়া ঘরে ঘরে পানি তোলার পাম্প, যেখানে খুশি সেখানে বসিয়ে যখন তখন বিদ্যুতের সুইচ টিপে দিলেই জলে জলাকার হয়ে যায়! বৃষ্টি কোন ছার এখনকার মানুষের কাছে! ফলে বৃষ্টির জন্যে আগের মতো মোনাজাত, প্রার্থনার প্রয়োজন হয় না, পীর-আউলিয়াদের নামে শিন্নি করা, মাজারে মানত করা, হিরালীর তাবিজ পুঁতার দরকার পড়ে না!
বৃষ্টির প্রশস্তি কেউ আর গায় না গাঁয়ে গাঁয়ে। পাড়ায় পাড়ায় হয় না ব্যাঙের বিয়ের আয়োজনও! শৈশবে এমন কোনো চৈত্রমাস দেখিনি ব্যাঙের বিয়ে ছাড়া! প্রকৃতই বলতে হয়, আমি এমন একটা অঞ্চল থেকে এসেছি, যে অঞ্চলটা দেশের আর দশ-বিশটা অঞ্চল থেকে ভিন্ন। সেখানে পলিমাটির ভিতর দিয়ে যেমন ফল্গুধারার মতো নদী বয়ে যায় বুকে অথৈ জলের ভার নিয়ে, ঠিক তেমনই আবার ডাঙার অনাবৃষ্টি এক সুকঠিন অবস্থার সৃষ্টি করে হাওড়বাসী কৃষকের মনে।
ধানগাছগুলো নেতিয়ে প`ড়ে যখন জলাভাবে মনে হয় মৃত, তখন কৃষকের বুকের ভিতরেও মূলত নেতিয়ে পড়ে প্রাণ! সেচের জলের ব্যবস্থা ছিল সনাতন। আধুনিক কৃষিপদ্ধতি ও সরঞ্জাম ছিল না বললেই হয়। তবু মানুষেরা টিকে থেকেছে আর তাদের এ টিকে থাকার শক্তি ছিল আসলে তাদের বিভিন্ন সামাজিক আচারানুষ্ঠান। এক কথায় হাওড়পাড়ের মানবিক `সংস্কৃতি`।
খরা, অনাবৃষ্টি, ঝড়, অকালবন্যা, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত ,ভূমিকম্প, মহামারি— এতসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক মানুষ সংঘবদ্ধভাবে মোকাবেলা করেই এ পর্যন্ত টিকে আছে। আর দীর্ঘ দীর্ঘদিন ধরে মানুষের টিকে থাকার যে সংস্কৃতি তা মানুষকে সাহসী, আত্মপ্রত্যয়ী করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও আজ আর সেসব সংস্কৃতির লেশমাত্র নেই। অনেকে জানেন না, জানতেও আগ্রহবোধ করেন না, কোথায় কি সংস্কৃতি ছিল আমাদের।
বিশ্বায়নের নামে ভিনদেশি, বহুদেশীয় জীবনব্যবস্থার সাথে সম্পর্কের কারণে দূরদেশীয় সংস্কৃতির দুষ্টু ছায়া পড়ে ক্রমে অস্পষ্ট, ধূসর আজ আমাদের সংস্কৃতি। তাই এ চরম গ্রীষ্মের দিনেও কোথাও কোনো ব্যাঙের বিয়ের খবর না পেয়েই মনের ভিতরে গুমরে ওঠলো, পুরাতন দিনের পাতা থেকে উপচে পড়লো কিছু স্মৃতি। যার সবটাই শৈশবের অমলিন স্মৃতিরই পুনর্পাঠ হয়ে থাকবে হয়তোবা! না হলে এমন করোনাদুর্গতিকালে কেউ ব্যাঙের বিয়ে দিতে মায়াকান্না কাঁদবে কেন!
অনাবৃষ্টি আর খরায় যখন তীব্র রোদে পুড়ে কাঠফাটা চৌচির হয়ে যেত ধানি জমিগুলি, তখন কৃষকের আত্মাও মনে হয় শুকিয়ে যেত ফসলহানির আশঙ্কায়। তথা অন্নচিন্তায় হারাম হয়ে উঠত তখন চোখের ঘুম। এক ফোঁটা বৃষ্টির পানিকে রহমতের পানি মনে করে তাকিয়ে থাকতো আকাশের দিকে হাওড়পাড়ের কৃষকসম্প্রদায়। তৃষ্ণার্ত খা খা মাঠ দেখে যেমন কৃষকের বুকের ভেতর হাহাকার হতো, আবার কৃষকের মলিন মুখের কাতরতাও বিষণ্ণ করে তুলতো একইভাবে গৃহবাসী কৃষাণীর অন্তর।
আর তাই হয়তো যে বৃষ্টির জন্যে কৃষকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়তো তা সরাতে গৃহলক্ষ্মী নারীরা তাই ঘটা করে আয়োজন করতো ব্যাঙের বিয়ের। প্রথম কবে ভাটির সংস্কৃতির সাথে এটির সংশ্লেষ ঘটে তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এ কথা খুব সত্য যে অপরাপর শাখাউপশাখা বেয়ে মূলত তা প্রয়োজন থেকেই উদ্ভূত। মনে আছে, শৈশবের গাঁয়ে চৈতের মাঝামাঝি প্রবল টানা খরান (খরার আঞ্চলিক শব্দ) শুরু হলে যখন ধানক্ষেতের অবস্থা জলাভাবে ত্রাহি ত্রাহি ঠিক সে সময়টাতেই যেন ব্যাঙের বিয়ের উৎসব শুরু হয়ে যেত হাওড়বর্তী গ্রামাঞ্চলে।
প্রায় বাড়িরই আঙিনায় কোনো অংশে চারকোণে চার কলাগাছ পুঁতে মাটির উপরে বর্গাকার দাগচিহ্ন টেনে কাদালেপা করে বিচিত্র রঙে ফুললতা, পাখির পা, ব্যাঙের পা, মাছ, ধানের ছবি আঁকা হতো। ঘরের বড় মহিলারা পুরো ব্যাপারটা তদারকি করলেও সাজসজ্জা ও অলংকরণের কাজটা বাড়ির ছোটবড় ছেলেমেয়েরা মিলেই করতো। লাল মাটি দিয়ে লেপা ঘরের ভিত শুকিয়ে গেলে তার উপর নানা ধরনের-রঙের নকশা করা হতো। চুনের সাথে হলুদবাটা মিশালে যে লালগোলাপি রঙের সৃষ্টি হয় তা আমি ওই ব্যাঙের বিয়ের ঘর সাজাতে গিয়েই শিখেছিলাম।
ভেন্না পাতা ছিঁড়ে তার শিরা দিয়ে পাখির পা আঁকা ছিল সহজ। এছাড়া কচু পাতা, শিম পাতা, শুধু চুন বা হলুদ এবং গ্রামের ছোট্ট দোকান থেকে কিনে আনা আলতাকাঠি, খুনিরঙ দিয়ে আল্পনা আঁকা শেষ হলে রঙিন কাগজের বিচিত্র নিশান-ঝালর কেটে সীমানা নির্দেশ করা সুতলিতে ঝুলিয়ে দেয়া। ক্রমে রঙিন শাড়ি পরিয়ে কোনো দুই কোণের দুইটি কলাগাছকে নতুন বর-০কনের মতো ঘোমটাপরা বধূর ধরনে সাজিয়ে, মাথায় মুকুট পরিয়ে নুইয়ে রাখা। সারাদিন ধরে বিয়ের বাসরঘর সাজানোর পর বিকেলবেলা কুলা ও হাঁড়ি নিয়ে ব্যাঙের বিয়ের আয়োজকরা পাড়ায় বেরিয়ে পড়তো চাল সংগ্রহের জন্যে।
ঘরে ঘরে গিয়ে বিয়ের গীত গেয়ে গেয়ে চাল তুলতো ছেলেমেয়ের দল। কেউ চাল দিতে না করতো না। কারণ বৃষ্টি সবারই প্রয়োজন। সে চাল দিয়ে পরে রান্না হতো মিষ্টি পায়েস। মূল অনুষ্ঠান শুরু হতো সন্ধ্যার পরে। সবাই সেজেগুজে বসতো ব্যাঙের ঘরে। ছোট্টদের হৈ হল্লা শুরু হতো, বয়স্কা মহিলারা আসতেন, গীত গেয়ে মুগ্ধ করতেন পাড়া। তাদের গীতের লহরে আশপাশের বাড়িগুলি থেকে ছুটে আসতো নারীশিশুরা। বৃষ্টির জন্যে আহাজারি করা সেসব শৈশবের অকৃত্রিম সুর ও ছন্দের গীত। দলবেঁধে যখন গাওয়া হতো তখন চারদিক হতে যেন অপরিমেয় এক ক্রন্দনের রোল ওঠতো!
`আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই’ জাতীয় বর্ণাঢ্য ধরনের বাণীসমৃদ্ধ গীত যাদের একটি কলিও আজ আর মনে নেই। এর আগেই বাড়ির পাশের ডোবা থেকে ধরো আনতে হতো ব্যাঙ। ব্যাঙের ঘরের মেঝেতে দুটো আলাদা আলাদা গর্তে পানি দিয়ে রাখা হতো। এই ব্যাঙ ধরার কাজটা আমরা ছেলেরাই করতাম। ঠেলাজালি দিয়ে দুচারটা ব্যাঙ ধরা তখন মহানন্দের ব্যাপার ছিল। গাঁয়ের ডোবা, বিল, খাল, নালা, আধলা পুকুর সবখানে ব্যাঙের অঢেল আবাস ছিল। গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা বিশ্বাস করতো যে, ঘনঘন ব্যাঙ ডাকলে বৃষ্টি হয়। তাই প্রতীকী বিয়ের মধ্য দিয়ে তারা ব্যাঙ ভায়া, ব্যাঙ আপার বিয়ের আয়োজনের ফূর্তি দিয়ে আসলে বৃষ্টিরই বন্দনা গাইতো। আজ আর সে ব্যাঙের বিয়েও নেই, সে গীতও নিরুদ্দেশ!
লেখক: কবি
























