ভবিষ্যতের মানুষ আবদুল মান্নান সৈয়দ

অমিতাভ পাল

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৫, ২০১৯

আবদুল মান্নান সৈয়দের মধ্যে এমন একটা বর্তমান কালের বৈশিষ্ট অনুপস্থিত ছিল— যা তাকে একালের মানুষ না বানিয়ে ভবিষ্যতের মানুষ বানিয়ে দিয়েছে। জীবনানন্দ দাশ তার কোনো এক লেখায় বলেছিলেন, সভ্যতার এখন ভাঙাগড়ার সময় চলছে। অর্থাৎ সভ্যতা কোন পথে চলবে, কি হবে তার স্বরূপ এবং সেসময় মানুষের আচরণ এবং বৈশিষ্ট কেমন হবে— সেটা এখনো নির্ণিত হয়নি। আর নির্ণিত হয়নি বলেই মানুষের পায়ে চলার পথ এখনো শেষ হয়নি। এই চলিষ্ণুতা শেষ হলে অন্য এক চলিষ্ণুতার সময় আসবে মানুষের জীবনে— যার কিছুটা ইশারা পাওয়া যায় আইজাক আসিমভের ফাউন্ডেশন ট্রিলজির মধ্যে। তো, কি সেই বৈশিষ্ট্য— যা আবদুল মান্নান সৈয়দের মধ্যে না থাকায় তাকে আমরা ভবিষ্যতের মানুষ বলে অভিহিত করতে পারি? এই বৈশিষ্টের নাম ধূর্ততা, যা মানুষকে মানুষের কাছে আসতে না দিয়ে বরং এমন এক প্রতিযোগিতামূলক লড়াইয়ের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে, জীবনানন্দের এক কবিতায় যাকে বর্ণনা করা হয়েছে ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের রক্তের উপমায়।

আমি আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে যতটা সময় কাটিয়েছি, সেই সময়ের কোনও মুহূর্তেই তার শরীর কিংবা মন বা চিন্তা থেকে ওই ধূর্ততাকে প্রতিফলিত হতে দেখিনি। অথচ এখনকার পৃথিবীতে এই বৈশিষ্ট্য না থাকলে টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে যায়। আমি নিশ্চিত, আবদুল মান্নান সৈয়দেরও টিকে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল, কখনো কখনো মুখ ফুটে তা তিনি বলেছেনও কোনও অন্তরঙ্গ পরিস্থিতিতে, কিন্তু তার সেই বেদনা বোঝার মতো হৃদয় এবং হৃদয়ের অনুভূতি আমাদের থাকলে তো? এই হৃদয় এবং হৃদয়ের অনুভূতি থাকবে ভবিষ্যৎ মানুষের, যে তার সহযাত্রীদের নিয়ে একটা সম্পূর্ণ দলের মতো একক হয়ে বাস করবে পৃথিবীতে এবং এদের মধ্যে কেউ একটু কষ্ট পেলে মহাহৃদয়ে ধ্বনিত হবে সেই কষ্টের শব্দ, একটি হৃদয়ের আনন্দের শব্দ বেজে উঠবে সব হৃদয়ে। দল এবং একক শব্দ দুইটিকে যতই পরস্পরবিরোধী মনে হোক না কেন— আসলে নিষ্পাপ, কলুষহীন এবং যথার্থ দল কিন্তু একক একটি সত্তাই। মানব শরীরের উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো যেতে পারে।

এই শরীরে প্রত্যেকটি প্রত্যঙ্গ নিজের নিজের কাজ করছে ব্যক্তিগতভাবে, অথচ এসব কাজ শেষপর্যন্ত একক একটি শরীরের কাজ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, একটা একক লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে এর মাধ্যমে। সমাজতান্ত্রিক যে সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন কার্ল মার্কস— সেটাও অনেকটা এইরকমের কিন্তু শুরুর দুর্বলতাকে প্রাপ্তবয়স্কের সহায়তা দিয়ে যেভাবে কাটিয়ে ওঠার পথ করে দিতে হয়— সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে সেটা না করে আমরা বরং নতুন এই শিশুটিকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে আনন্দে লাফাচ্ছি এই বলে, শত্রুর বিদায় হলো। সমাজতন্ত্র যদি মানুষের শত্রু হয় তাহলে আমার মা আমার সবচেয়ে বড় শত্রু। যেকোনও দেশপ্রেমিকও ওই একই অর্থে দেশের বৃহত্তম শত্রু হবে। আজ যদি দেশপ্রেমের বন্যায় ভাসতে থাকা তরুণ সমাজের প্রতিনিধিদের বলি, আপনারাই এই দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু, তাহলে কিলের একটাও বোধহয় আমার পিঠ ছাড়া মাটিতে পড়বে না। সমাজতান্ত্রিক ধারণা যে ধরণের দেশপ্রেমের জন্ম দেয়— তা ওই মানব শরীরের উদাহরণের মতো। এর ফলেই বহু ক্ষুদ্র শক্তির সমাবেশ এমন বৃহৎ শক্তির জন্ম দেয়— যার মুখামুখি হতে বুক কাঁপে পৃথিবীর সেরা সমরশক্তিরও।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ভিয়েতনামের মার্কিনবিরোধী লড়াই কিংবা হিটলারের আগ্রাসন থেকে লেনিনগ্রাদ শহরকে মুক্ত করার সেই কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাওয়া বাস্তবতা এই সমাজতন্ত্রেরই বহুত্বকে এককে পরিণত করার সূত্রের ফলাফল মাত্র। সমাজতন্ত্রের শক্তির ভয়াবহ ঐক্যের এই দুই তিনটি উদাহরণ দেখেই টনক নড়ে গেছে শোষক সমাজের। মিথ্যা গল্পে এবং ক্রমাগত প্রোপাগান্ডায় ওই শক্তিকে দৈত্য বানিয়ে তাকে ভয় করতে শেখানো হয়েছে আমজনতাকে এবং এনজিও জাতীয় তাৎক্ষণিক সাহায্যের কোরামিন দিয়ে মৃতপ্রায় জনতাকে বাঁচিয়ে রেখে দমিয়ে দেয়া হয়েছে তার রাগ এবং সেই রাগের মাধ্যমে জোট বাঁধার প্রচেষ্টাকে। আর এভাবেই আজকের পৃথিবীকে ঠেলে দেয়া হয়েছে বিগত পৃথিবীর অশিক্ষা ও অন্ধকারের গুহায়। ওই অশিক্ষা ও অন্ধকারের মধ্যে থাকা পৃথিবীর মানুষের অন্যতম একটা বৈশিষ্ট হলো ধূর্ততা। এছাড়াও অনেক এই ধরণের বৈশিষ্ট তার আছে যথা— মেয়েদের মানুষ হিসাবে না দেখা, তাদের লেখাপড়া করতে না দেয়া, ডাইনি অপবাদে এগিয়ে যাওয়া মেয়েদের পুড়িয়ে মারা, মানুষকে দাস হিসেবে দেখা ইত্যাদি এবং এসব বৈশিষ্ট্যকে মধ্যযুগের অন্ধকার হিসেবে দেখে মানুষ তাকে বর্জন করার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে চেয়েছিল যদিও, কিন্তু ভাইয়ের শত্রু ভাই-ই সেই পথ রুদ্ধ করে আটকে দিয়েছে মানবকে।

তবুও এরই মধ্যে— এই অন্ধকার এবং অশিক্ষার মধ্যে সবসময়ই কিছু কিছু মানুষ অস্বস্তি বোধ করে এর থেকে বাইরে চলে যেতে চেয়েছেন তাদের নিজের প্রচেষ্টায়। আবদুল মান্নান সৈয়দ এধরণের স্বপ্রচেষ্ট মানুষদের একজন। জ্ঞান অর্জন এবং লেখার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা বিনিময় ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্যতো সক্রেটিসেরও ছিল, ছিল রবীন্দ্রনাথের, লালনেরও। এসব মানুষ— এই সক্রেটিস, রবীন্দ্রনাথ বা লালন যেমন তাদের সময়কে ধারণ করার পরও মহাসময়কে ধারণ করেছেন ভবিষ্যৎ মানবের গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে এবং এভাবেই হয়েছেন ভবিষ্যতেরও মানুষ— আবদুল মান্নান সৈয়দের ভবিষ্যতের মানুষ হওয়ার রাস্তাটাও এদেরই মতো। এরা প্রত্যেকেই যেমন যন্ত্রণা পেয়েছেন সমকালের কাছ থেকে, আবদুল মান্নান সৈয়দও পেয়েছেন। ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে তাকে আটকে রাখার চেষ্টা হয়েছে, হয়েছে লেখক সত্তাকে খণ্ডিত করার চেষ্টাও। কিন্তু কাজই যেহেতু শব্দ করে জানিয়ে দেয় কাজীর পরিচয়, তাই আবদুল মান্নান সৈয়দেরও সঠিক পরিচয় আমরা পেয়ে গেছি তার কাজের শব্দের ভিতর দিয়েই। একমাত্র কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া বাংলা সাহিত্যে আর কোনও লেখক সম্পূর্ণ বিপরীত দুই বিষয় নিয়ে সমান দক্ষতায় তার মতো লিখে যেতে পারেননি। শেষ জীবনে অভিনয় এবং নাটক নির্মাণের চেষ্টা তার অভিযানপ্রিয় মনটাকে আরো স্পষ্টভাবে চিনিয়ে দেয়। অভিযাত্রীরতো আকাশের ছাদ আর মাটির মেঝে নিয়েই ঘর।

আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে প্রায় পঁচিশ বছর আগে পরিচিত হয়েছিলাম আমি। তিনি তখন আবিদ আজাদ সম্পাদিত ‘শিল্পতরু’ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক আর আমি তরুণ কবি। কবিতা দিয়ে পৃথিবীকে নিজের মতো করে তৈরি করার বাসনায় তখন আমার উদ্দাম দিনগুলো কাটছে। কিন্তু সেই উদ্দামতার সঙ্গী বিশেষ কেউ নেই— নেই প্রশ্রয়দাতাও। এইরকম সময়েই আমার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘নতুন বাল্বের আলো’ প্রকাশিত হয়। তাকে সেই পাণ্ডুলিপিটি দেখিয়ে তার মন্তব্য পাওয়ার আশায় গিয়েছিলাম বিরাট উঠানজুড়ে গাছপালায় ভরা তার গ্রিনরোডের বাসায়। কিন্তু বাসায় না বসে তিনি আমাকে এবং আমার সঙ্গী রিফাত চৌধুরীকে নিয়ে গিয়ে বসলেন তার বাসার কাছেরই একটা মিষ্টির দোকানে (দোকানের নাম বোধহয় ছিল, নিমন্ত্রণ)। সেখানে সন্দেশ খেতে খেতে তিনি দেখেছিলেন আমার পাণ্ডলিপিটি এবং একটা কাগজে লিখেও দিয়েছিলেন কয়েক লাইন। সেই লাইনগুলিতে লেখা কিছু কথা ছিল— আমার কবিতা তাকে বিস্মিত করেছে এবং বাংলা কবিতায় একটি নতুন ধারারও জন্ম হয়েছে এসব কবিতার ভিতর দিয়ে। ওই বইটি নিয়ে মান্নান ভাই এবং আবিদ ভাই ছাড়া আর কেউই তেমন কিছু বলেননি।

‘কনস্পিরেসি অফ সাইলেন্স’ বা নিরবতার ষড়যন্ত্র তখন আমাকে ঘিরে ফেলেছিল চারপাশ থেকে এবং হতাশাও। কিন্তু হতাশার সেই দিনগুলিতে মান্নান ভাই প্রায়ই বলতেন লিখে যেতে এবং লিখেই সব অপমান ও আঘাতের জবাব দিতে। পাশাপাশি এটাও বলতেন— লেখাই লেখকের সবচেয়ে বড় শত্রু। আবদুল মান্নান সৈয়দের ওই কয়েকটি লাইন এবং লিখে যাওয়ার পরামর্শ আমাকে যে প্রেরণা জুগিয়েছিল সেদিন— সেটাই এখনো পর্যন্ত আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে সাহিত্য। আগামী দিনের কবিকে তার মতো করে প্রেরণা দিতে আর কোন প্রতিষ্ঠিত কবিকে কখনো দেখিনি আমি। আবদুল মান্নান সৈয়দের এই গুণটিকেও ভবিষ্যতের মানুষের গুণ বলে মনে হয় আমার। একা বাঁচা যায় না এবং সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয় এগিয়ে যাওয়ার পথের কাজ— এটা আমার অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া ধারণা। আমার বিশ্বাস, আবদুল মান্নান সৈয়দেরও এই ধারণা ছিল এবং তরুণ কবিরা এর জন্যই প্রশ্রয় পেতো তার কাছে।

আমার সাহিত্য জীবনে তিনজন মানুষকে পেয়েছিলাম— যাদের অনায়াসেই আমার মেন্টর বলে মনে করতে পারি। এই তিনজন হলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, মুস্তফা আনোয়ার এবং আবিদ আজাদ। মুস্তফা ভাই চলে গেছেন সবার আগে, তারপর আবিদ ভাই প্রস্থান করেছেন রঙ্গমঞ্চের বাইরের জগতে। শেষমেষ চলে গেলেন মান্নান ভাইও। মেন্টর বলতে যাদের বুঝেছিলাম— তাদের কেউই আর আমার হতাশার দিনগুলিতে পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে বলবেন না— অমিত লিখে যান, লেখাই আপনার কাজ এবং এই লেখাই আপনাকে শক্তি জোগাবে সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। আমার বাবা মারা গেছেন বছর চারেক হলো। আর এই তিন মেন্টর, বিশেষত মান্নান ভাই মারা যাওয়ার পর নিজেকে দ্বিতীয়বার পিতৃহীন বলে মনে হয়েছে আমার। প্রকৃত দুর্ভাগা বোধহয় আমাকেই বলা যায়।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক