মানুষকে ঘৃণা করা আমাদের মজ্জাগত

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৯

আমাদের মতো ছ্যাচড়া, ভণ্ড আর মিথ্যাবাদী জাতি জগতে আর দ্বিতীয়টা নাই। আমরা ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের নিজেদের বিষয়ে বিভিন্ন মিথ্যা ধারণা দিয়ে বড় করি, মানে জীবনে চলার পথের ভিত্তিই তৈরি করি মিথ্যা আর প্রহসনমূলক কথাবার্তা বলে। প্রথমে বলি, বাঙালি এক মহান, উদার, সরল-সহজ, ধর্ম নিরপেক্ষ আর সাম্যে বিশ্বাসী জাতি।

ডেইলি সোপ অপেরার মতো, আমাদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। আমরা কারো ক্ষতি করতেই পারি না, উল্টা সৃষ্টির আদি থেকে অন্য জাতি আমাদেরটা লুটেপুটে খাচ্ছে। আমাদের বোকা বানিয়ে খেয়েছে বৃটিশরা, তারপরে পাকিস্তানিরা। আর আমরা সিরিয়ালের ভাবিদের মতো খালি মুখে কাপড় গুজে কেঁদে চলেছি। এই যে আমাদের ঐতিহাসিক কান্না শুরু হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়ে ৫০ পার হতে চলেছে, আমাদের কান্না বন্ধ হবার নাম নাই। ইশ, কী নিরীহ জাতি! তামাম দুনিয়ার সবাই খারাপ, কেবল আমরাই ভালো।

কিন্তু, এই আমরাটা কে? আর এই আমরার মধ্যে কারা কারা আছে, সেটা নিয়ে আমাদের নির্দিষ্ট কোনও ধারণা নাই। একেকজনের কাছে এই আমরার গণ্ডি একেক রকম। মুসলমানদের কাছে তারা ছাড়া আর বাদবাকি সবাই খারাপ, এমনকি বিহারীদেরও আমরা খারাপ ভেবে ভেবে বড় হয়েছি। হিন্দু বা খ্রিস্টানদের কাছে মুসলমানরা খারাপ, এর মধ্যে বিহারী আর হাল আমলে যুক্ত হয়েছে রোহিঙ্গারা। পাহাড়িদের কাছে বাঙালি বলতেই খারাপ।

রাজশাহীর লোক বরিশাল বা কুমিল্লার লোককে দেখতে পারে না, নোয়াখালীর লোক সিলেটের লোককে অপছন্দ করে আর ঢাকার লোকেরা তাবৎ দেশের লোকেদের হেয় করে। এই আমাদের কালচার, মানে মানুষকে ঘৃণা করা আমাদের মজ্জাগত বিষয়। যেই জাতি অন্য মানুষের জন্য এতটা বিদ্বেষ নিয়ে বড় হয়, সেই আবার মনেপ্রাণে নিজেকে উদার আর সরল মনে করে। দেখেছেন, কী বড় ভণ্ডামি!

আজ এক রোহিঙ্গা তরুণীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রথম আলোর মতো আলোর ফেরিঅলাও তাদের পাঠক সমাবেশ থেকে বাদ দিয়েছে রোহিঙ্গা তরুণীকে, যেন রোহিঙ্গা হলে পত্রিকা পড়া বন্ধ রাখতে হবে। আসামে যাদের দেশহীন করা হলো, তাদের জন্য আমাদের দরদ, আমরা কাশ্মীরের জন্য চোখের পানি ফেলে ফেলে অন্ধ হতে বসেছি, ফিলিস্তিনিদের জন্য কাঁদতে কাঁদতে মরছি। এক সময় রোহিঙ্গাদের জন্যও পথে নেমেছি, আর আজ যেমন নিজেদের ভাগে কম পড়ার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে, রাতারাতি একটা জাতিকে মেরে কেটে শেষ করে দেয়ার পক্ষে আমাদের মত।

কাকে দেখলাম লিখেছে, একটা একটা রোহিঙ্গা ধর, ধরে ধরে জবাই কর। সেই আবার হয়তো সকালে উঠে বলবে, ভারত বাজে দেশ কারণ ওরা গোমূত্র পান করে।

আমার মূল কথা, রোহিঙ্গাদের জন্য আমি কোনও মায়াকান্না করছি না। তারা যদি নিরাপদে নিজেদের দেশে ফিরে যায়, সেটাই আমাদের জন্য ভালো, এর কোনও বিকল্প নাই। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা হলো, ভণ্ডামি দেখতে আর ভালো লাগছে না। যেকোনো একটা বেছে নেন। হয় নিজের সুবিধা দেখেন, ইসরায়েল বা ভারতের মতো সব মেরে সাফ করার পক্ষে মত দিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন, না`হয় মানবতার পক্ষে থাকেন। ভারত বা আমেরিকা করলে দোষ আর আপনি করলে ‘ব্যাপারটা বুঝতে হবে’ এটা ভাই কোন দেশের লজিক?

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী