মানুষের জন্য কোরান, কোরানের জন্য মানুষ নয়

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৭, ২০২০

ইসলামের প্রধানত দুটি দিক আছে। শরিয়ত ও মারেফাত। শাস্ত্রগত ও আধ্যাত্মিক দিক। আমার বাবা ছিলেন শরিয়তপন্থি সুফি। অর্থাৎ শাস্ত্রপন্থি অধ্যাত্মবাদী। শাস্ত্র ও অধ্যাত্মবাদের একটা সমন্বয় ছিল তাঁর মধ্যে। ধর্মের মধ্যপন্থাকে অবলম্বন করেছিলেন তিনি। যাপনও করেছেন একধরনের বৈরাগ্য জীবন। তিনি বলতেন, ‘মানুষের জন্য কোরান, কোরানের জন্য মানুষ নয়। মানুষের জন্য মসজিদ, মসজিদের জন্য মানুষ নয়।’ তিনি আমার শিক্ষকও। আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ মূলত তাঁর কাছেই নিয়েছিলাম। পারস্যের কবি জালাল উদ্দিন রুমি, ওমর খৈয়াম, হাফিজ, দাকিকি, জামি ও শেখ সাদির অসংখ্য ‘শের’ বা কবিতা ছিল তাঁর মুখস্থ।

আমাদের শৈশব-কৈশোরে তিনি মধ্যযুগের মুসলিম কবি ও চিন্তকদের জীবনকাহিনি শোনাতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আমরা, অর্থাৎ আমি এবং আমার বাল্যবন্ধু আমানউল্লাহ ও আশ্রাফ আলী, তাঁর কথা শুনতাম। শুনতে হতো মাথা নিচু করে, ভয়ে তাঁর চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না। একবার শুরু করলে সহজে থামতে চাইতেন না। আমাদের গ্রামে দিনে চারবেলা ট্রেন আসত। আমরা সকালের ট্রেন ধরে জেলাশহর যাব, কিন্তু দেখা গেল সকালের ট্রেন চলে গেল, দুপুরের ট্রেনও চলে গেল, অথচ তাঁর কথা শেষই হচ্ছে না। আসলে তিনি চাইতেন আমরা যেন এসব মনীষীর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিই। তিনি প্রায়ই একটি শের আবৃত্তি করে শোনাতেন, ‘মান না গুনজম দর জমিনে আসমা/লেকে গুনজম দর কুলুবে মোমেনা।’ অর্থাৎ, আল্লাহ জমিনে নেই, আসমানে নেই; আল্লাহ আছেন বিশ্বাসীর অন্তরে। কিন্তু তিনি এর অর্থ করতেন, ‘আল্লাহ জমিনে নেই, আসমানে নেই; আল্লাহ আছেন মানুষের অন্তরে। ‘বিশ্বাসীর’ স্থলে তিনি ‘মানুষ’ যুক্ত করে দিতেন। আমরা ভেবে পেতাম না, আল্লাহ কেমন করে মানুষের অন্তরে থাকেন! এ কী করে সম্ভব?

পরবর্তীকালে তাঁরই উৎসাহে আমি পাঠ শুরু করি খ্যাতনামা মুসলিম চিন্তকদের জীবন ও দর্শন। আমার মধ্যে তখন একটা জেদ ছিল, যে করেই হোক এঁদের সম্পর্কে জানতেই হবে। পড়তে পড়তে আবিষ্কার করতে পারি, আমার বাবার জীবন ও ধর্মদর্শনে বায়েজিদ বোস্তামি, শিহাব উদ্দিন সোহরাওয়ার্দি, ইবনুল আরাবি, জালাল উদ্দিন রুমি, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ প্রমুখের চিন্তাধারার একটা প্রভাব ছিল। রক্ষণশীল চিন্তক আল গাজালির চিন্তার চেয়ে তিনি উদারপন্থী ইবনুল আরাবির সর্বধর্ম সমন্বয়বাদী দর্শনকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। এই কারণে তিনি হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন করতেন না। তিনি বলতেন, হিন্দুরা যাতে এই দেশে নিরাপদে থাকতে পারে, এটাও ইসলামের শিক্ষা।

বিস্ময়ের সঙ্গে আমি আরো আবিষ্কার করি, রক্ষণশীল মুসলিমরা বর্তমানে যেসব মুসলিম মনীষীকে নিয়ে গৌরববোধ করে, জীবৎকালে তাঁদের কেউ রক্ষণশীলদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন, কেউ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। দার্শনিক আল কিন্দি ও ইবনুল আরাবিকে কাফের ফতোয়া দেওয়া হয়, মনসুর হাল্লাজকে হত্যা করা হয় শূলে চড়িয়ে, আল রাজিকে অন্ধ করে দেওয়া হয়, ভিন্নমত পোষণের অভিযোগে কবি ফেরদৌসীর লাশ মুসলিম গোরস্তানে দাফন করতে দেওয়া হয়নি, ওমর খৈয়ামকে নাস্তিক উপাধি দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁর ঘর, ইবনে রুশদ ও সোহরাওয়ার্দিকে করা হয় অপমান-অপদস্ত ও নির্যাতন।

পরবর্তীকালে আমি যখন নাট্যকার সেলিম আল দীনের সাহচর্যে আসি, দৈনিক ‘সমকালে’ কীভাবে ফিচার লিখতে পারি, সেই ব্যাপারে আলাপ করার জন্য একদিন তিনি আমাকে পাঠালেন কবি ও গবেষক সাইমন জাকারিয়ার কাছে। তিনি তখন ‘সমকালে’র একটি পাতা সম্পাদনা করতেন। কিন্তু তাঁর পাতায় লেখার সুযোগ ছিল না। তাঁর সুবাদে পরিচয় হয় ‘সমকালে’র সহসম্পাদক মাওলানা হোসেন আলীর সঙ্গে। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল মানুষ। অন্ধবিশ্বাস অপেক্ষা যুক্তিকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। তিনিই আমাকে অনুপ্রাণিত করেন মধ্যযুগের মুসলিম কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিকদের নিয়ে লিখতে। আমি লিখতে শুরু করলাম। মাসে দুটো করে লেখা ছাপা হতে থাকে ‘সমকালে’।

এরই মধ্যে আমি যোগ দিই সেলিম আল দীনের একান্ত সচিব হিসেবে। তিনি সাধারণত দৈনিক পত্রিকা পড়তেন না। কিন্তু যেদিন ‘সমকালে’ আমার লেখা ছাপা হতো সেদিন মনোযোগ দিয়ে লেখাটি পড়তেন। এই বলে উৎসাহ দিতেন, ‘বাহ! খুব ভালো কাজ, লিখে যা।’ মাঝেমধ্যে আমাকে দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাগত ছাত্রছাত্রীদের বলতেন, ‘তার লেখা পড়েছিস! দর্শন নিয়ে অনেক ভালো লেখে, পড়ে দেখিস।’ এসব বলে আসলে তিনি আমাকে জ্ঞানকাণ্ডে উৎসাহিত করতেন। তাঁর উৎসাহেই পরবর্তীকালে প্রতীচ্য দর্শন পাঠ শুরু করি।

একদিন ঢাকার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বাঙলায়নের প্রকাশক কবি অস্ট্রিক আর্যু প্রস্তাব দিলেন, ‘সমকালে’ প্রকাশিত লেখাগুলো নিয়ে তাঁকে একটা পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে দিতে। তখন সবে আমি লেখালেখি শুরু করেছি। কোন লেখা প্রকাশ করতে হবে আর কোনটি হবে না, এই বিবেচনাবোধ তখনো তৈরি হয়নি। তাঁর প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে প্রাচ্যের ভাবআন্দোলনের গতিধারা নাম দিয়ে একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করে পাঠিয়ে দিলাম তাঁকে। ২০০৯ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইটি প্রকাশিত হয়।

কেটে গেল এগারো বছর। এবার আমার মনে হলো, পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো দিয়ে বই প্রকাশ ঠিক হয়নি। লেখাগুলোর আরো সংস্কার, পরির্তন ও পরিবর্ধন প্রয়োজন। নইলে ভবিষ্যতের পাঠক আমাকে ভুল বুঝতে পারে। তাছাড়া বর্তমান মুসলমানরা যেভাবে কট্টর রক্ষণশীলতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, এই ধরনের বই অনেক বেশি প্রয়োজন। শুরু করলাম সম্পাদনা। কিছু প্রবন্ধ বাদ দিলাম, যুক্ত করলাম নতুন কিছু প্রবন্ধ। পাল্টে দিলাম বইয়ের নামও। নতুন নাম রাখলাম, ‘মুসলিম মনন ও দর্শন : অগ্রনায়কেরা।’ অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ উপলক্ষ্যে রোদেলা প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশিত হলো। এখন থেকে ‘প্রাচ্যের ভাবআন্দোলনের গতিধারা’ বইটি বাতিল বলে গণ্য হবে।

‘মুসলিম মনন ও দর্শন : অগ্রনায়কেরা’ বইয়ে মোট বাইশজন মুসলিম চিন্তকের জীবন, মনন ও দর্শনের উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। এমনভাবে করেছি, যাতে সর্বসাধারণ সহজে বুঝতে পারে। দর্শনের জটিল তত্ত্বগুলোকে অধিকতর সহজ করে তোলার চেষ্টা করেছি। বইটি পড়ে একজন পাঠকও যদি অশিক্ষা, কূপমুণ্ডূকতা, চরমপন্থা ও আন্ধেলা পুকুর থেকে মুক্তি পান, আমার আনন্দের সীমা থাকবে না।

মানুষের জয় হোক। পৃথিবীর সকল প্রাণীর কল্যাণ হোক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক