মারিয়া সালাম

মারিয়া সালাম

মারিয়া সালামের আত্মগদ্য ‘কেউ বলেনি, তুমি কেমন আছ’

প্রকাশিত : মে ১৪, ২০২০

ছোটবেলা থেকে কয়েকটা কথা মাথায় গেঁথে নিয়ে বড় হয়েছি। খুব সাবধানে চলতে হবে, হিসাব করে চলতে হবে, নিজের ক্ষতি হয় এমন কিছুই করা যাবে না, জীবনে অনেক বড় হতে হবে, ছোট ভাইবোনদের দেখে রাখতে হবে, আর সবচেয়ে বড় কথা পরিবারের সম্মান নষ্ট হয় এমন কিছুই করা যাবে না।

বাড়িতে পুকুর ছিল বলে মা উঠানে একটা দাগ কেটে দিয়ে বলত, এর বাইরে বের হবে না, হলেই বিপদ। আমি কোনোদিন সেই দাগ পার করে বাইরে বের হইনি। একটু বড় হয়ে পড়েছিলাম, ইকারাস-ডিডালাসের গল্প। জেনেছিলাম সীমা অতিক্রম করা যাবে না, গেলেই সমুদ্রে পড়তে হবে। জীবনে কোনোদিন সীমা অতিক্রম করিনি।

মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতাম, কোনও কোনও দিন যে এর ব্যত্যয় হয়নি সেরকম না। তবে কেউ কোনোদিন অভিযোগ করার সুযোগ পায়নি। ভালো মেয়ে, ভালো ছাত্র, ভালো বন্ধু, ভালো আত্মীয়, ভালো প্রতিবেশী, পরিবারের ভালো সদস্য, ভালো সহকর্মী, যে সংগঠন করেছি সেখানেও ভালো সদস্য হবার চেষ্টা করেছি।

একদম কম বয়সে যখন মেয়েরা পোশাক বা গয়নাগাটি নিয়ে বা তা নাহলেও দামি একটা ফোন সেট নিয়ে মাতামাতি করে, আমি সংসারের বোঝা কাঁধে তুলে নিয়েছি। সংসারে সচ্ছলতা আনতে এমন কোনও পরিশ্রম নাই করিনি। নিজে একটু কষ্ট করলেই যদি পরিবারের জন্য ভালো কিছু করা সম্ভব হয়, তাই করেছি। এইসময় কেউ একটা বাচ্চার চাপ নিতে নারাজ, আমি চারটা বাচ্চাকে নিয়ে শান্তি খুঁজেছি। ভালো মা হতে চেয়েছি, কতটুকু পেরেছি জানি না, তবুও শত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সন্তানদের দায় এড়িয়ে যেতে পারিনি।

আমার মতো কম বেতনের একজন চাকুরে কতটা সংযম করলে একটা বাড়ি করতে পারে, একটা গাড়ি কিনতে পারে বা আর কিছু না হোক বোনের বিয়েটা সাহস করে দিতে পারে, ভাইদের বলে, চিন্তা নাই, পড়তে থাক, টাকা ম্যানেজ হবে? আমার বন্ধুরা সবসময় বলত, তুই কত সুখী! ভাইরা বড়বড় প্রতিষ্ঠানে পড়েছে, বোনের বিয়ে দিয়ে দিয়েছিস, বাড়ি করে ফেলেছিস, ভালো চাকরি করিস, সেখানে মন চায় যেতে পারিস। কিন্তু এইটুকু করতে আমাকে কতটা মানসিক চাপ নিতে হয়েছে, কত রাত মনের শখ, স্বপ্ন বালিশের তলায় চাপা দিয়ে ঘুমাতে গেছি, কেউ খবর রাখেনি।

কেবল একের পর এক দায়িত্বের বোঝা চেপেছে কাঁধে। প্রতিদিন নিত্যনতুন অভিযোগ শুনেছি, এই সংসারে মন নাই, বাচ্চাদের যত্ন নাই, এই কথা বলা ঠিক হয় নি, ফেসবুকে এই ছবি দেয়া ঠিক হয়নি, অমুকের সাথে মিশে ভুল করেছ, অমুক লো ক্লাস, তোমার পারসোনালিটির সাথে এই আচরণ যায় না, উফ এইটা হাস্যকর.... এই অভিযোগ শেষ হবার না।

দিনের পরে দিন গেছে আমি মানুষ থেকে মেশিন হয়ে গেছি সবার কাছে। আমার রাতে ফেসবুকে থাকা অপরাধ, প্রেমের গল্প লেখা হাস্যকর, বাড়ির বাইরে বেশিক্ষণ থাকা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, সংসারের সব কাজ করতে হবে, টাকার যোগানও ঠিক রাখতে হবে, বাচ্চাদের যত্নও নিতে হবে, নামযশও বাজায় রাখতে হবে, রাগ করা যাবে না, উত্তেজিত হওয়া যাবে না, মন খারাপ হলেও অভিযোগ করা যাবে না।

পৃথিবীর সকল সতী নারীদের মতো, উপন্যাসের আদর্শ নারীদের মতো মুখে তালা দিয়ে, সব ত্যাগ স্বীকার করে আমাকে আজীবন চলতে হবে। আমাকেই কেবল মেশিনের মতো বা খোদার মতো নির্ভেজাল আর নিপাট হতে হবে। আমাকেই কেবল... এই বোঝার তলে চাপা পড়ে কতদিন চোখের পানি ফেলেছি, তখন আমি হয়ে গেছি বড্ডবেশি অবুঝ, অপরিপক্ব। কিন্তু, কেউ কোনোদিন বলেনি, তুমি কেমন আছ? তুমি কি চাও? তুমি একটু বিশ্রাম নাও, আমরা এবার দেখছি।

জীবনে এতগুলো বছর পার করে যখন হিসাব করলাম, আর কতদিন বাঁচব? বড়জোর আর ত্রিশ বছর, আর সুস্থ থাকব কতদিন? একটাই তো জীবন! সবাইতো যার যার জায়গায় ভালো আছে, একটা পর্যায়ে আছে, এবার আমি একটু নিজের মতো করে ভালো থাকি। তখনই আমার এতদিনের সব কিছু ভালো ধুলায় মিশে গেল!

ছোটবেলার বন্ধু, আত্মীয়, ভরসার মানুষ, কাছের মানুষ সবাই সবার আসল চেহারা নিয়ে সামনে প্রকট। কেবল, মা-বাবাই আগলে ধরে রাখল, ঢেকে রাখল ভালোবাসার চাদরে। কেবল তারাই বলল, আমরা চাই তুমি শান্তিতে থাকো, সুস্থ থাকো।

লেখক: গল্পকার ও গণমাধ্যমকর্মী