সক্রেটিসের মূর্তি
মৃত্যু আমাকে নেবে, রাষ্ট্র আমাকে নেবে না
মৃদুল মাহবুবপ্রকাশিত : মার্চ ২৭, ২০২০
সক্রেটিসের পালানোর সুযোগ ছিলে মৃত্যু এড়ানোর জন্য, কিন্তু তিনি পালান নাই। প্লেটোর বয়ানে যা যা শোনা যায় তার সার কথা হলো, সে মূলত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অস্বীকার করতে চান নাই। রাষ্ট্র ভুল করলেও তা যে গুরুত্বপূর্ণ, সাধারণের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য তা তিনি বোঝাইতে মৃত্যু মেনে নিয়েছেন। রাষ্ট্রের আইনকে অস্বীকার করলে রাষ্ট্র অবান্তর হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অবান্তর প্রমাণ করতে চান নাই তিনি। এটা স্বেচ্ছামৃত্যুই। এবং তিনি এও বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্র এটা অন্তত বুঝতে পারবে একদিন। এই জন্যই বলছেন, `আই হ্যাভ টু ডাই, উই হ্যাল টু লিভ, হুইচ ইজ বেটার অনলি গড নোজ।’ফলে আত্মদানের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রকে তিনি বাঁচিয়ে গেছেন। এগুলো মূলত প্লেটোর সাজানো প্লট। এই গল্পের বাইরে প্লেটো একটা কথা উহ্য রেখেছে মনে হয়। তিনি সক্রেটিসের বয়ানে তা বসিয়ে দিতে পারতেন। আসল কথাটা লেখা উচিত ছিল, `দুনিয়াতে পালিয়ে যাবার কোনও রাষ্ট্রই নাই। ফলে আমার মূলত পালানোর কোনও জায়গা নাই। পলানো আর না পলানোর ফলাফল সমান। ফলে মৃত্যুকে ফেস করাই ভালো। তোমরা আমাকে বাঁচানোর জন্য যাই বলো না কেন, একদিন এর মাহাত্ম বুঝবা। আই হ্যাভ টু ডাই, উই হ্যাল টু লিভ, হুইচ ইজ বেটার অনলি গড নোজ।`
সক্রেটিস থেকে প্লোটোর রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ছিল বেশি। রামরাজ্যের মতো প্লেটোনিক রাষ্ট্রের বাসনা তার ছিলে। ফলে রাষ্ট্রের পক্ষে সাফাই দিয়ে প্লেটো দুনিয়ায় এমন এক শাসন ব্যবস্থার ওকালতি করেছে যেখানে মানুষের লুকানোর কোনও জায়গা আর অবশিষ্ট নাই। অতীব সেন্ট্রালাইজড। সক্রেটিস হলো আসল রিবেল, বিপ্লবী। তিনি মূলত রাষ্ট্রের আসল রূপ উন্মোচন করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। রাষ্ট্র মানুষকে তার নিজ প্রয়োজনে বাঁচায়, নিজ প্রয়োজনে প্রায়োরিটি সেট করে মেরে ফেলে। তার উদাহরণ হয়ে সক্রেটিস মারা গিয়েছেন। কিন্তু তার বিপ্লব বেহাত হয়েছে প্লোটের মিথ্যা সংলাপের ভেতর দিয়ে।
দুরিয়াতে হয় সক্রেটিসের মতো হেমলক খেতে হবে অথবা প্লেটোর মিথ্যা রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। প্লেটো হলো আসল ভিলেন। সক্রেটিস নামের কোনও একক চরিত্র ছিল না। সক্রেটিস মূলত সন্মিলিত জনগণের প্রতিরূপ যা প্লেটো তৈরি করেছেন। এবং এই জনগণকে হেমলক বিষ খাওয়ানোর আগদিয়ে নানা বয়ান তৈরি করে নিয়েছে রাষ্ট্রের সাফাই গাওয়ার জন্য। আসল সক্রেটিসকে মূলত পাওয়া যায় এরিস্টোফেনিসের কমেডি নাটক দ্য ক্লাউডের ভেতর। ঐটাই আসল সক্রেটিস, সে মূলত জনগণের প্রতিনিধি, বিশেষত্বহীন।
কিন্তু প্লেটোর মহান সক্রেটিসকে বিষ খাইতে হয় এবং একজন চিকিৎসক যার কাজ মানুষকে বাঁচানো, তিনি তার মৃত্য নিশ্চিত করেন। এটা হলো গ্রীক আইরনি, পলেটিক্স। ফলে, প্লেটের বয়ানে সক্রেটিসের যা যা বনায়ন তা স্ক্রিপটেড, মিথ্যায় ভরা।
দুনিয়ার সকল নাগরিকদের প্রতীক হলো সক্রেটিস যারা প্রত্যেকে হেমলকের পরিবর্তে করোনা নিয়ে বসে আছে। কারো মৃত্যু হলে আমরা স্বেচ্চা মৃত্যুর ঘোষণা দিবো এবং বলবো রাষ্ট্রই আমাদের বাঁঁচিয়ে রাখে। নাগরিকদের মৃত্যুর কারণ সম্পদের অপ্রতুলতা ও অসম বন্টন ব্যবস্থা না। বরং রাষ্ট্র ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন না শোনাই তাদের মৃত্যুর কারণ। ফলে পুলিশি লাঠিপেটা দিয়ে ঘরে রাখার ব্যবস্থা হলো রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শুভ ইচ্ছা ও সৎ উদ্যোগ আমাদের প্রতি। ফলে মৃত্যু আমাকে নেবে, রাষ্ট্র আমাকে নেবে না।
হাজারে হাজারে সক্রেটিস আদমজীবাণুবোমা হয়ে উঠছে। নিজের মৃত্যুর দায় নিজেকেই নিতে হবে।
লেখক: কবি