প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

যারা বেঁচে থাকবে তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ কি শেষ হবে

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০২০

১৯৭৫ সাল। আমার মা বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। সালটি আমার মনে থাকার কথা নয়। তবুও যে মনে আছে তার কারণ, বঙ্গবন্ধুকে পরিবার-পরিজনসহ নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা।

মাকে শুইয়ে রাখা হতো হোগলার বিছানার উপরে কলাপাতা বিছিয়ে তার উপরে। মায়ের বুকে আর পিঠে গুটিবসন্ত ছেয়ে গিয়েছিল। খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন মা। পিঠ বিছানায় লাগাতে পারতেন না। তাকে অনেক কষ্ট করে কাত হয়ে শুয়ে থাকতে হতো। একদিকে কাত হয়ে বেশিক্ষণ শুয়ে থাকা যায় না। মা অল্প সময়ের মধ্যেই অস্থির হয়ে উঠতেন। মাকে ধরে অন্যদিকে কাত করে দিতে হতো। গায়ে হাত রাখার মতো কোনো সুস্থ জায়গা ছিল না। বাবা অনেক সতর্কতার সঙ্গে মাকে পাশ ফিরিয়ে দিতেন। তাতেও মা কষ্ট পেতেন। বড় বোন মাহমুদা আর তাহমিদা রান্নাবান্না আর পয়পরিষ্কার করা নিয়ে সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকে। আমি আর শাহজাহান কাছে থেকে থেকে মায়ের এই কষ্ট দেখতাম।

শাহজাহান ছিল খুব নরম মনের মানুষ। কারো কষ্ট সহ্য করতে পারত না। সেখানে মার কষ্ট দেখে সারাদিন ওরা মাথা খারাপ থাকে। ও কী বলে, কী করে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। ও কবিরাজ ধরে আনে। রাস্তার ফকির ধরে নিয়ে আসে। মসজিদের হুজুরকে নিয়ে আসে। মাদারস এতিম ছেলেদের ধরে নিয়ে আসে। কারো অছিলায় মা যদি ভালো হয়ে যান। ও যাকে আসতে বলে সে-ই চলে আসে। কেউ না করে না। ওর সঙ্গে এমনই সম্পর্ক ছিল সবার। বাবা বকেন। আমার কিন্তু ভালো লাগে। আমারও মনে হয়, কারো দোয়ায় মা নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবেন। বড় ভাই রুহুল আমিন ব্যস্ত থাকে নানা কাজে। মায়ের কলাপাতার বিছানার চারদিকে বিছিয়ে রাখা হয়েছিল বিষকাটালি গাছ।

ঘরের দরজায় দরজায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বিষকাটালি গাছ। বাবা সারাক্ষণ মায়ের সেবাশুশ্রূষায় ব্যস্ত থাকেন। মা বলতেন, “রাস্তা দেখলে তোর বাপের হাঁটতে ইচ্ছা হয়, আর মানুষ দেখলে কথা বলতে ইচ্ছা হয়। কী যে একজন মানুষ!”

আড্ডাপ্রিয় এই মানুষটি এখন সারাক্ষণ মায়ের কাছে থাকেন। এখন মাকে নিয়েই তার যত ব্যস্ততা। সেই সময় ১৫ আগস্ট সকালে ফুফি হন্তদন্ত হয়ে বাবাকে ডাকতে লাগল, ভাইজু, অ ভাইজু, হুনছেন, শেখ সাহেবেরে তো মাইরা হালাইছে।

বাবা জানেন, সিরাজের মা অনেক আওফাও খবর দেয়। তাই বিশ্বাস না করে বললেন, হাবিয়া, সকাল বেলা তোর কি মাথা খারাপ অইল?

কিন্তু ফুফিকে বিমর্ষ দেখে বাবার বুঝতে বাকি থাকল না যে ঘটনা মিথ্যা নয়। বাবা বললেন, কই হুনলি?
ওই হুনেন, রেডুতে কইতেছে।
পাশের ঘরে ছাত্তার কাকার রেডিও ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা খবরটা জেনে ফেললেন।

মায়ের অবস্থা ভালো নয়। কষ্টের ভেতর দিয়ে বাবার সময় যাচ্ছে। এই সময় শেখ সাহেবকে হত্যার খবর পেয়ে বাবা ভেঙে পড়লেন। চিরকাল আশাবাদী মানুষটি হঠাৎ করে বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। ময়ের মৃত্যুচিন্তা ভর করে বাবার উপর। তিনি নিশ্চিত হয়ে যান যে, আমাদের মা আর বাঁচবেন না। তার বিশ্বাস বিপদ এক সঙ্গে আসে।

৭৪ এ ভারতে এই রোগটি মহামারি আকার ধারণ করেছিল। বিশ্বা স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে ওই বছর জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে আক্রান্ত হয়েছিল ৬১ হাজারের উপরে মানুষ। মারা যায় ১৫ হাজারের অধিক। তারই ধারাবাহিকতায় ৭৫-এ বাংলাদেশে এই রোগটির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

মা বেঁচে গিয়েছিলেন। এমনকি দাগগুলোও মুছে গিয়েছিল। একটা সময় ছিল মুখে বসন্তের দাগ নিয়ে অনেক লোক ঘুরে বেড়াতে দেখা যতো। অনেকে অন্ধ বা বধির। এই ধরনের লোক এখন আর সচরাচর দেখা যায় না। বাবার দুশ্চিন্তা ছিল, মা যদি বেঁচেও থাকেন তা হলেও অন্ধ বা বধির হয়ে বেঁচে থাকবেন। তবুও যেন বেঁচে থাকেন এই ছিল বাবার প্রার্থনা।

মা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছেন। চাচাত ভাই গোলাম হোসেন বাড়ি থেকে চলে গেছে। চাচাত ভাইবোন কেউ আমাদের সীমানায় আসে না। আমাদের ঘরে তো আসার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আমি সারাক্ষণ মার কাছে ঘুরঘুর করি। মার মাথার কাছে বসে থাকি।

বিষকাটালির ডাল দিয়ে মার গা চুলকিয়ে দিই। নিমপাতা, আম পাতা, জাম পাতা গরম পানিতে দিয়ে মাকে গোসল করানো হয়। আমি তখন মার কাছে থাকি। পাতাগুলো মায়ের শরীর থেকে সরিয়ে দিই। আর মায়ের কষ্ট দেখি। ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্ট পাই। কাউকে বলি না। কী বলব? বলার কী আছে? রাতে গোপনে কাঁদি আর আল্লাহ্ কাছে বলি, “আল্লাহ্, আমার মা অনেক ভালো একজন মানুষ। মাকে অনেক ভালোবাসি আমারা। মা আমাদের অনেক ভালোবাসেন, অনেক আদর করেন। মা না থাকলে এই আদর কোথায় পাব আল্লাহ্? কোথায় গিয়ে আমারা দাঁড়াব? মাকে ভালো করে দাও আল্লাহ্।”

একরাতে কাঁদতে কাঁদতে হিক্কা ওঠে যায় আমার। শাহজাহান শুনতে পায় আর হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আমাদের কান্নার শব্দে চোখ লেগে আসা বাবা জেগে উঠেন এবং কেঁদে ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বাবা আমাকে কোলে করে বাইরে নিয়ে যান। আমাদের এই কান্নার শব্দ শুনে মাহমুদা, তাহমিদা, হামেদা আমার ভাইবোন সবাই কাঁদতে শুরু করে। প্রতিবেশীরা জেগে যায়। তারা ভাবে, মা হয়তো মারা গেছেন। তারাও ওঠে আসে। ঘটনা জেনে তারা দোয়া করেন “আমাদের এই শিশুদের মুখের দিকে চেয়ে আল্লাহ্ যেন রহমত নাজিল করেন। আমার মা যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন। আল্লাহ্ রহমত নাজিল করেছিলেন।

পরদিন থেকে মা আস্তে আস্তে সুস্থ হতে লাগলেন। এক সময় পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। মার শরীরের কোনো অংশ ক্ষতি হয়নি। আমার মা ভালো হয়ে গেলেন। আমরা কেউ আক্রান্ত হইনি। বিভিন্ন সময় যারা মাকে সেবাশুশ্রূষা করেছে তারাও কেউ আক্রান্ত হয়নি। বাবা ভালো ভালো বাজার করতে লাগলেন। ভালো ভালো খাবারের আয়োজন হতে লাগল। ঘরে প্রতিদিন আনন্দ, উৎসব। কিন্তু সেই আনন্দের আয়োজন আমাদের জন্য। ছেলেমেয়েদের জন্য। বাবা ভেতরে ভেতরে কষ্ট লালন করছেন। শেখ সাহেব নেই। আপনজন বলতে কেউই জীবিত নেই। বিদেশ-বিভুঁয়ে এতিম মেয়ে দুটি কীভাবে বেঁচে আছে! কী করে, কী খায়, কী পরে!

আমার মা-বাবা কেউই আর এখন বেঁচে নেই। ২০০০ সালে একটি দুর্ঘটনায় আমার ভাই শাহজাহান, ভাবি ও তিনটি ছেলে-মেয়ে রেখে মারা যায়। তখন ও চাঁদপুরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করত এবং অধিকাংশ সময় মা-বাবর কাছেই থাকত। আমরা বুঝতাম অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতার এই ছেলেটির প্রতি মা-বাবার দরদ বেশি। বাবা আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন, এই ছেলেটির মতই যেন তার মৃত্যু হয়। ২০০৭ সালে তিনিও অনুরূপ দুর্ঘটনায় মারা যান। পুত্রমৃত্যুর শোকে আমার মা দুই-দুইবার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমার জন্মের পূর্বে শিশুপুত্র নুরুল আমিন আগুনে পুড়ে মারা গেলে প্রথমবার এবং শাহজাহান দুর্ঘটনায় মারা গেলে দ্বিতীয় বার।

২০১২ সালে মা মারা যান। প্রায় এক যুগ তিনি সামান্য মানসিক অসুস্থতার মধ্যে ছিলেন। চুপচাপ বসে থাকতেন বা শুয়ে থাকতেন। কারো সঙ্গে তেমন কোনো কথাবার্তা বলতেন না। সংসারের কয়েকজন খুব প্রিয় মানুষের সঙ্গেই দু-একটি কথা বলতেন। সামান্য পার্কিন্সনিজমও ছিল। হাত সামান্য কাঁপত। এই সময় তার পুত্রবধূ অর্থৎ শাহজাহানের স্ত্রী এবং তার কন্যা হামেদা ও তার নাতি-নাতনিরা তাকে নতুন বধূর মতো সাজিয়েগুজিয়ে রাখত। আমরা বাড়িতে গিয়ে সারাক্ষণ মায়ের সান্নিধ্যে থাকতাম। মার সঙ্গে দুষ্টুমি করতাম।

তার প্রতি বাবার ভালোবাসা ও মমত্ববোধ ভোলার মতো নয়। বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন মাকে অফুরন্ত যত্ন আর মমত্বের মধ্যে রেখেছেন। দুর্ঘটনার পরে বাবাও মাস তিনেক চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনিও পুত্রবধূ, ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের যত্ন ও ভালোবাসার মধ্যে ছিলেন। আজ ভাবি, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর হাজারো মা-বাবা, ভাবই-বোন, ছেলে-মেয়ে মারা যাচ্ছে। কিন্তু কোনো আপনজন কাছে থাকতে পারছে না। প্রচণ্ড কষ্টের দিনগুলোতে প্রিয়জনের মুখ দেখতে পাচ্ছে না কেউ। আনন্দ-বেদনায়, সুখে-দুঃখে যারা ছিল প্রাণের মানুষ, যাদের স্নহে, ভালোবাসায়, প্রেমে জীবন আন্দন্দিত হয়ে উঠেছিল, শেষ সময়ে তারা কেউই কাছে থাকতে পারল না, এর চেয়ে কষ্টের যন্ত্রণার আর কী হতে পারে।

যারা বেঁচে থাকল তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ কি কোনো দিন শেষ হবে? হবে না। তাই মহান স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি, পৃথিবীকে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করার শক্তি যেন তিনি আমাদের দান করেন।

লেখক: শিক্ষাবিদ