রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘ভারতে মুসলিম শাসকদের দ্বারা হিন্দু শোষণ!’

প্রকাশিত : মার্চ ১৪, ২০২০

ইংরেজরা এটা প্রচার করেছে, মুসলিম শাসনে ভারতে হিন্দুরা ছিল অত্যাচারিত এবং শোষিত। কলকাতার লর্ড বিশপ ১৮২৪ সালে বলেছিলেন, এটা আশা করা যেতেই পারে হিন্দুরা সব সময়ে স্মরণে রাখবে যে, আমরা তাদের দেশ দখল করেনি, বরং তাদেরকে আমরা এসে অন্যের দখলে দেখেছি, পূর্ববর্তী শাসকরা এবং তাদের ধর্ম ভারতবাসীর কাছে আমাদের তুলনায় অনেক বেশি অপ্রত্যাশিত ছিল, এবং তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি কুখ্যাত অত্যাচারি শাসক রূপে শাসন করেছেন। (অমর দত্ত, ঊনিশ শতকের শেষার্ধে বাংলাদেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদ পৃ. ২)।

বারবার এ কথা প্রচারিত হতে হতে ভারতে অনেকেই এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, ভারতে মুসলমানদের শাসন ছিল দুঃশাসন। ফলে শীঘ্রই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদের রেখা তৈরি হয়। কিন্তু এ কথা স্মরণ রাখার দরকার, মুসলমানদের অত্যাচারে হিন্দুদের কখনো ভারত ছাড়তে হয়নি। সেরকম কোনো উদাহরণ বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ইতিহাস বলে বিভিন্ন হিন্দু শাসকদের শাসনামলে ভারতে বৌদ্ধদের উপর নিপীড়ন হয়েছিল, আর সেকারণে অনেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ভারত ছেড়ে পালিয়েছিলেন। ভারত থেকে পালিয়ে বিভিন্ন দেশে তারা আশ্রয় নেয়ার ফলে সেসব দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রসার লাভ করে। ভারতের চেয়ে বৌদ্ধদের জনসংখ্যা বহু বহু গুণ বেশি ভারতের বাইরে। মুসলমান শাসকরা যদি এতই অত্যাচার করে হিন্দুরা তখন অতিষ্ঠ হয়ে পালালেন না কেন?

বাংলায় মুসলমান শাসকদের অত্যাচারের কিছু নমুনা দেখাচ্ছেন প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহ। তিনি লিখেছেন যে, দশভাগের নভাগ জমিদারী ছিল হিন্দুদের হাতে। আর নিম্নতম রায়তদের অধিকাংশ ছিল মুসলমান। কানুনগোদের দপ্তরও প্রায় একচেটিয়াভাবে হিন্দুদের হাতে ছিল। ফার্মিঙ্গারের পঞ্চম প্রতিবেদনে জানা যায় যে ১৭২৮ সালে বাংলাদেশের বৃহত্তর পনেরোটি জমিদারির মধ্যে মাত্র দুটি ছিল মুসলমানদের হাতে বাকি তেরোটি ছিল হিন্দুদের। ঠিক একইভাবে ছোট একুশটি জমিদারির মধ্যে মাত্র দুটি ছিল মুসলমানদের হাতে বাকি সব হিন্দুদের হাতে। তারিখ এ বাংলার লেখক সলিমুল্লাহও এই একই বিবরণ দিয়েছেন। তাছাড়া প্রধান প্রধান ব্যবসা-বাণিজ্য ও মহাজনী কারবারও ছিল হিন্দুদের হাতে। মুসলমানরা প্রধানত ছিল কৃষক ও কারিগর। ইজারাদার হিসেবে মুর্শিদকুলী খান কেবল বাঙালি হিন্দুদেরই নিয়োগ করতেন। (পঞ্চনন সাহা, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক: নতুন ভাবনা, পৃ, ৭৮)। মুসলমান শাসকরা হিন্দুদের এতই অত্যাচার করতেন যে, জমিদারির নব্বই শতাংশ তাদের দখলে রয়ে গেল! মুসলমানদের হিন্দু বিদ্বেষ সত্ত্বেও ব্যবসা-বাণিজ্য, ইজারাদারের চাকরি সব তারাই পেতেন। শাসকদের পক্ষ থেকে খুব নতুন ধরনের অত্যাচার নয় কি?

বাংলা তখন মুঘল সম্রাটের অধীন। মুঘল শাসনের দুশো বছর পার হয়ে গেছে, অথচ বাংলার জমিদারির নব্বই শতাংশ রয়ে গেল হিন্দুদের হাতে। অথচ বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা অনেক বেশি। সিরাজদৌলার সময় ইতিহাসে বা নাটকে বিরাট ব্যবসায়ী হিসেবে কি একজনও মুসলমানের নাম পাওয়া গেছে? সত্যি বলতে সামরিক বিভাগ আর বিচার বিভাগে মুসলমানরা সংখ্যায় বেশি ছিল। মুঘল সম্রাটের সামরিক বিভাগের প্রধান প্রধান পদগুলিতে আবার রাজপুতদের প্রাধান্য। সেখানে অনেক মারাঠারা আছেন। কিন্তু সম্রাট বা বাংলার নবাববের দরবারে অমাত্যদের বড় একটা অংশ হিন্দু। রাজস্ব, অর্থনীতির প্রধান পদগুলিতে ছিলেন হিন্দুরা। ইংরেজদের রচিত ইতিহাস বা পরবর্তীতে রমেশচন্দ্র-যদুনাথদের যে বক্তব্য মুসলমান শাসকদের দ্বারা হিন্দুদের প্রতি অত্যাচার সেটা কি টিকছে? মুঘল শাসকরা বা আওরঙ্গজেব যদি হিন্দু বিদ্বেষী হতেন, সাম্রাজ্যের অর্থনীতি এবং প্রশাসনের মূল স্তম্ভ জমিদারিগুলি কি হিন্দুদের হাতে রাখতেন? সামরিক বাহিনীর মূল পদে কি রাজপুতদের বসাতেন? সামান্য বিচার-বিবেচনা কী বলে? নিজেদের বিচার বিবেচনা না খাটিয়ে ইংরেজদের প্রচার বিশ্বাস করলেই হবে? বর্তমান রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের বিদ্বেষের দিকে তাকালে কি মনে হয়, হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ বলে তখন কিছু ছিল? থাকলে কি মুসলমানদের শাসনে হিন্দুরা এত পদ দখল করে রাখতে পারতেন? মুসলমান শাসকরা হিন্দু বিদ্বেষী হলে জমিদারের যে তালিকা দেয়া হলো, সেটা ঠিক বিপরীত দাঁড়াতো।

ফলে ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষের প্রধান কারণ ইংরেজ শাসকরা। বিদ্বেষটাকে দিনে দিনে তারা বাড়িয়ে তুলেছিলেন, পরে হিন্দু-মুসলমানরা তার শিকার হয়েছেন। বর্তমানে সেটা রয়ে গেছে ভিন্ন চেহারায়। খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করলে, বিভেদের কারণগুলি চিহ্নিত করতে পারলে তা মিটে যাবে। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সেই অতীত যুগের সম্প্রীতি ফিরে আসবে।